কল্লোল মজুমদার,মালদা: কালো পিচের রাস্তার দু’ধারে সারি সারি আমগাছ। ঝুঁকে পড়েছে মুকুলের ভারে। পুরো এলাকাজুড়ে মুকুলের গন্ধ মাদকতা ছড়িয়েছে। ইংরেজবাজারের প্রত্যন্ত গ্রাম শৈলপুরের রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগোতেই থমকে যায় চোখ। ভাঙাচোরা একটা চাটাইয়ের বাড়ির বারান্দায় বসে রয়েছেন বছর ত্রিশের এক মহিলা। আর তাঁর পায়ে বাঁধা নাইলনের দড়ি। এমন অমানবিক ঘটনা দেখে প্রশ্ন করতেই গ্রামবাসী বলে ওঠেন, কী আর করবে ওর বাবা। তিন মেয়েই যে মানসিক ভারসাম্যহীন। এভাবেই বছরের পর বছর বেঁধে রাখতে হয় ওদের। বাকি দুই মেয়ে কোথায়? প্রশ্ন ছুড়তেই উত্তর আসে, কে জানে। কোনওরকমে পায়ের দড়ি খুলে পালিয়ে গিয়েছে। আর মা ছুটেছে ওদের ধরতে। আজ না হয় কাল খুঁজে পাবে হয়তো।
শৈলপুরের বাসিন্দা শেখ জাক্কার। বয়স পঁচাত্তর পার হয়েছে সেই কোনকালেই। নিজস্ব সম্পত্তি বলতে এক চিলতে জমি আর গোটা কতক ছাগল। সেই জমিতে চাষ করেই কোনওরকমে দুই বেলা পেট ভরে সংসারের। এই মুহূর্তে সংসার বলতে স্ত্রী আর তিন মেয়ে। স্ত্রী মালেকা বিবি ছাগল চরান। আর বাড়িতে তিন মেয়ের দেখাশোনা করেন।
তিন মেয়ে বলতে গোলবানু খাতুন, জলি খাতুন আর টুম্পা খাতুন। গোলবানুর বয়স পঁয়ত্রিশ। জলির ৩২ আর টুম্পার ৩০। কিন্তু নিয়তির কী পরিহাস, ওরা তিনজনেই মানসিক ভারসাম্যহীন।
ওদের বাড়ি শৈলপুরের রাস্তার ধারে। বাড়ি না বলে মাথা গোঁজার ঠাঁই বললেই ভালো। বাঁশের বেড়া দেওয়া ঘর। আর মাথায় টিন, তাও আবার ফুটো। বর্ষায় যাতে ঘরে জল না পড়ে, তার জন্য ওই ফুটোর উপর দেওয়া আছে পলিথিন। মাটির বারান্দায় ধানের গোলা। একপাশে পর পর দুটো ঘর। একটি ঘরে ঠাঁই পাঁচটা বড় মানুষের। একটা ঘরে রাখা হয় বাড়ির পোষ্য কয়েকটি ছাগল। সাতসকালে মা মালেকা বিবি ছাগল চরাতে বের হয়ে যান। আর ছাগলের ঘরে পায়ে দড়ি বেঁধে রেখে যান তিন মেয়েকে। বাবা-মা বাড়ি ফিরলে তবেই খুলে দেওয়া হয় পায়ের দড়ি।
কতদিন এভাবে চলছে ? প্রশ্ন করতেই অসহায় বাবার আর্তি, ‘বছরের পর বছর ধরে। তাও বছর ত্রিশ …।’ চিকিৎসা করাননি কেন? জাক্কার সাহেবের জবাব, ‘বার বার বলেও আমাদের বার্ধক্যভাতা জোটেনি। তার উপরে তিন মেয়ের এই অবস্থা। একবার চিকিৎসার জন্য মালদায় নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। কিন্তু সেখানে ভালো চিকিৎসাও হয় না। আর তাছাড়া শহরে বার বার নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করা অসম্ভব। তাই ওদের তিনজনকে বেঁধে চাষ করতে যাই।’
আঁচলের কোণে চোখ মুছতে মুছতে মা মালেকা বিবি অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠেন, ‘আমার বড় মেয়ে উলেমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। একমাত্র ও মানসিকভাবে সুস্থ। আর গোলবানু, জুলি, টুম্পা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন। ওদের বেঁধে রাখতে হয়। সুযোগ পেলেই পালিয়ে যায়। চারিদিকে খোঁজাখুঁজির পর দুইদিন-তিনদিন পর খুঁজে পাওয়া যায়। সরকারের তরফে যদি কিছু পেতাম…।’ প্রতিবেশী উম্মে সালমার কথায়, ‘মা তো…। মন মানে না মায়ের। চোখের জলে দিন কাটে। এমন যদি হত, বাবা-মায়ের অবর্তমানে ওদের তিন বোনের খাওয়া-পরার কোনও অসুবিধা না হয়।’
কেন ওই অসহায় পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়নি নরহাট্টা পঞ্চায়েত? প্রশ্নের জবাবে প্রধান তনুজা বিবির মন্তব্য, ‘জানতাম না। ওদের জন্য কী করা যায়, দেখছি।’ আবারও একটা সকাল হবে। উঠবে সূর্য। আবারও তিন মেয়েকে দড়িতে বেঁধে ছাগল চরাতে যাবেন মা। এভাবেই নিয়তির হাত ধরে চলবে জলি-টুম্পাদের বাকিটা জীবন? উত্তরটা পাওয়া যাবে সময়ের প্রান্তরেখায়।