অরিন্দম বাগ, মালদা: দুপুর তখন প্রায় একটা বাজে। খিদে পেয়েছিল খুব। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভাবছি কী খাওয়া যায়, তখনই চোখে পড়ল তাঁকে।
দেখে মনে হল, ৬০ পেরিয়েছে বয়স। লুচি-সবজি বিক্রি করছিলেন বৃদ্ধা। নিলাম তাঁর কাছেই এক প্লেট।
‘এই চাঁদিফাটা রৌদ্রে এভাবে ঘুরে ঘুরে লুচি-সবজি বিক্রি করছেন। এই বয়সেও এত পরিশ্রম? বার্ধক্য ভাতার…,’ প্রশ্নের মাঝপথেই থামালেন বৃদ্ধা, ‘কিছুদিন আগে বাড়ির মালিক আমাকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার আর বার্ধক্য ভাতার জন্য আবেদন করতে বলেন। উনিই আবেদনের সমস্ত ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু এখনও সেসব কিছুই পাইনি।’
ভাড়া থাকেন বুঝি? পেশাদারিত্বের খাতিরে নয়, এমনিই কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম।
কথা বলে জানতে পারলাম, মালদা শহরের (Malda) সর্বমঙ্গলাপল্লিতে ভাড়া থাকেন আরতিদেবী। স্বামী অপূর্বরঞ্জন চক্রবর্তী খাবারের দোকানে কাজ করেন। প্রায় ১০ বছর আগে দুর্ঘটনায় তাঁদের ছেলে-বৌমার মৃত্যু হয়। সেই সময় থেকেই একমাত্র নাতনিকে আগলে রেখেছেন ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। সংসারের খরচ চালানোর পাশাপাশি নাতনির পড়াশোনার খরচ চালাতে গত তিন বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় লুচি বিক্রি করছেন এই প্রৌঢ়া।
আরও দুটো লুচি চেয়ে নিলাম। ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধার সঙ্গে কথায় কথায় উঠে এল তাঁর প্রাত্যহিক রোজনামচা। ভোর তিনটে থেকেই জীবন সংগ্রাম শুরু হয় তাঁর। ওই কাকভোরে উঠে বাড়ির কাজকর্ম সেরে লুচি-সবজি তৈরি করেন তিনি। প্রতিদিন প্রায় ৮০-৯০টা লুচি নিয়ে রাস্তায় বের হন বিক্রি করতে। সন্ধেবেলায় বিক্রি করেন সিঙ্গারা। এভাবেই পেট চলছে তিনজনের। কখনও রথবাড়ি বাজার, আবার কখনও বাসস্ট্যান্ডে বিক্রি করেন।
হাত-পায়ে আর সেই জোর নেই আগের মতন। পায়েও রয়েছে সমস্যা। নিত্য অভাবের সংসারে থাকার মধ্যে রয়েছে শুধু অদম্য মনোবল। আর সেই মনোবলকে সামর্থ্য করেই জীবনসমুদ্রে নৌকার হাল ধরেছেন আরতি চক্রবর্তী। বাপ-মা হারা নাতনিটাকে মানুষ করতেই হবে যে।
আরতিদেবীর কথায়, ‘প্রায় ১০ বছর আগে ২১ দিনের নাতনিকে আমার কাছে রেখে, ছেলে-বৌমা চেন্নাইয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় দুর্ঘটনায় ছেলে-বৌমার মৃত্যু হয়। সেই থেকে নাতনিকে মানুষ করছি। স্বামী খাবারের দোকানে কাজ করে দৈনিক একশো টাকা পান। কিন্তু এই টাকাতে সংসার কীভাবে চলবে, কীভাবে নাতনিকে পড়াশোনা করাব? তাই গত তিন বছর ধরে আমি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে লুচি-সবজি বিক্রি করছি।’
দাম মেটাতে মেটাতে না চাইতেও প্রশ্নটা করে ফেললাম, ‘আর এত রৌদ্রে যদি মাথা ঘুরে পড়ে যান, তখন কে দেখবে?’ প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রোদ গনগনে আকাশের ওপার থেকে ভেসে এল একটুকরো বিষণ্ণতা, ‘কী করব বাবা, কিছুই করার নেই। নাতনিটাকে তো মানুষ করতে হবে…।’
রৌদ্রতপ্ত রাস্তার বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস, ‘তরীখানা বাইতে গেলে/ মাঝে মাঝে তুফান মেলে, তাই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে…।’