অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শুধু বাংলায় নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে সমস্ত কুশীলবদের মধ্যে রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতায় অত্যন্ত বর্ণময় চরিত্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষকে সস্ত্রীক হাজির করিয়ে এবং তাঁর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ে পদ্ম শিবিরের অন্তঃকলহকে যেভাবে তিনি উসকে দিলেন, সেটাকে মাস্টারস্ট্রোক বলাই যায়।
অক্ষয় তৃতীয়ার দিন দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন ও সেটার প্রচার যেভাবে করা হয়েছে, তা কোনও ধর্মনিরপেক্ষ দেশের একটি অঙ্গরাজ্যের সরকার এবং তার মুখ্যমন্ত্রী করতে পারে কি না, সেটা অবশ্যই বিতর্কিত বিষয়। কিন্তু সেই বিতর্ককে ছাপিয়ে গিয়েছে রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে সস্ত্রীক দিলীপ ঘোষের যাওয়া এবং মুখ্যমন্ত্রীর পাশে বসে তাঁর খোশমেজাজে আড্ডা।
তাতে বেদম চটেছে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব। দিলীপ ঘোষের নাম উচ্চারণ না করলেও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যে তাঁর পদক্ষেপকে ভালো চোখে নেননি, সেকথা আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদাররা প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছেন, দিলীপের আচরণ বিজেপি অনুমোদন করছেন না। চুপ করে থাকেননি দিলীপও। তিনদিন ধরে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নানা কথা নানাভাবে বলে চলেছেন।
যেমন তাঁর বক্তব্য, তিনি যা করেন চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে করেন। তিনিই বিজেপিকে রাজ্যে দাঁড় করিয়েছেন। কিংবা যাঁরা সারাজীবন তিন-চারটি পার্টি করে বিজেপিতে এসেছেন তাঁরা তাঁকে জ্ঞান দিচ্ছেন। ক্ষুদ্র স্বার্থে যাঁরা জলঘোলা করছেন তাঁদের তিনি করুণা করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। বঙ্গ বিজেপিতে দীর্ঘদিন ধরে দিলীপ-শুভেন্দু, দিলীপ-সুকান্ত, শুভেন্দু-সুকান্ত দ্বৈরথের কানাঘুষো আছে। যা এতদিন চর্চায় থাকলেও এত বেআব্রু হয়নি। দিলীপের দিঘায় জগন্নাথ ও মমতা দর্শনে তা কার্যত রাস্তায় চলে এল।
বিজেপির বিভিন্ন নেতা-কর্মীরা যেমন দিলীপের সমালোচনা করছেন, দিলীপও তেমনি কড়া ভাষায় পালটা দিচ্ছেন। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের এমন খেয়োখেয়ি উপভোগ করছে তৃণমূল। দলীয় মুখপাত্রদের মন্তব্যে তা স্পষ্ট। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে দরকার সঠিক সময়ে সঠিক চাল। বিজেপি সবসময় তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তোলে। মুর্শিদাবাদে হিংসার পর সেই অভিযোগের তীব্রতা আরও বাড়িয়েছিল।
বিজেপির সেই মেরুকরণের রাজনীতির জবাবে দিঘার জগন্নাথ মন্দির এমনিতেই এখন মমতার প্রধান অস্ত্র। তার ওপর তাঁর সঙ্গে দিলীপের সৌজন্যের ছবি গেরুয়া শিবিরকে যৎপরোনাস্তি বিড়ম্বনায় ফেলেছে সন্দেহ নেই। এতে তৃণমূল নেত্রীর এক ঢিলে বিজেপির বহু পাখি কলরব শুরু করেছে। তাতে মানুষের কাছে বার্তা চলে গিয়েছে যে, ঘরোয়া কোন্দলে জর্জরিত অগোছালো দল বিজেপি।
রাজ্য বিজেপিতে সভাপতি নির্বাচন নিয়েও বেশ কিছুদিন ধরে ডামাডোল চলছে। নতুন সভাপতি বাছাই এখনও বিশবাঁও জলে। এই পরিস্থিতিতে দিলীপকে ঘিরে বিজেপির অন্দরের চেহারা সামনে চলে এল। শুভেন্দু-সুকান্তরা মুখে যাই বলুন, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরকে সামনে রেখে মমতা নিজের হিন্দুত্বের ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন। লক্ষ্যটা আগামী বছরের বিধানসভা ভোট।
অন্যদিকে, আরএসএসের প্রাক্তন প্রচারক দিলীপ ঘোষের মতো ডাকাবুকো বিজেপি নেতা মমতার পাশে হাজির হয়ে যাওয়ায় গেরুয়া শিবিরের ভোটের অনেক হিসেব গুলিয়ে গিয়েছে। বঙ্গ রাজনীতিতে শাসক-বিরোধী সৌজন্য এখন প্রায় অতীত। মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতা একসঙ্গে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সহমত হচ্ছেন কিংবা পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন- এমনটা বহু বছর দেখা যায় না। বরং বাংলায় শাসক ও বিরোধী শিবির পরস্পরকে প্রতিপক্ষের বদলে শত্রু হিসেবেই গণ্য করে।
এহেন রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে প্রধান বিরোধী দলের অন্যতম প্রধান নেতাকে পাশে বসিয়ে মুখ্যমন্ত্রী একটি ব্যতিক্রমী দৃশ্য তৈরি করলেন। তা নিয়ে বিতর্ক বাধিয়ে বিজেপি হয়তো নিজের পায়েই কুঠারাঘাত করেছে।