মালদা ব্যুরো: একদিকে ফুঁসছে নদী, আরেকদিকে গিলে নিচ্ছে ভিটেমাটি সহ সবকিছু। নতুন করে গঙ্গার তাণ্ডব শুরু হয়েছে রতুয়ায়। গত দু’দিনে মালদার (Malda) রতুয়ায় (Ratua) ভাঙনে বিপর্যস্ত দুশোরও বেশি পরিবার অন্যত্র সরে গিয়েছে। মঙ্গলবার রাতে গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছে দেড়শো বছরের পুরোনো একটি কালী মন্দির। তলিয়ে যাওয়ার মুখে ঝুলছে একটি পুরোনো শিব মন্দিরও। যে কোনও সময় সেই মন্দিরও নদীগর্ভে তলিয়ে যাবে। নদীতে তলিয়ে গিয়েছে একটি প্রাচীন বট গাছও। অবস্থার অবনতি হচ্ছে বৈষ্ণবনগর ও হরিশ্চন্দ্রপুরেও। যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে, তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। এই পরিস্থিতির জন্য ভাঙন নিয়ে ফের কেন্দ্রকে নিশানা করেছেন রতুয়ার বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায়। এদিকে, বৈষ্ণবনগরে গঙ্গা থেকে মাত্র কুড়িহাত দূরে থাকা জমির মাটি ভাঙন রোধের নামে কেটে নেওয়া হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, সেই মাটিই সিমেন্টের বস্তায় ভরে ভাঙনপ্রবণ এলাকায় ফেলছে সেচ দপ্তর। মালদা জেলার কালিয়াচক ৩ নম্বর ব্লকের পারদেওনাপুর-শোভপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পারলালপুর, গোলাপ মণ্ডলপাড়া ও শোভাপুর এলাকায় ভাঙন রোধের নামে এধরনের কাজকে কেন্দ্র করে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগ, আকাশ সরকার, নারদ বিশ্বাস ও এ সরকারের মালিকানাধীন জমি থেকে সেচ দপ্তর কিছু ঠিকাদারের মাধ্যমে মাটি কাটছে। এই জমিগুলো গঙ্গার খুব কাছে অবস্থিত। সেখান থেকে মাটি তুলে নেওয়ায় গোটা অঞ্চলের ভৌগোলিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে প্রবল ভাঙনের মুখে পড়তে পারে পারলালপুর, শোভপুর, বাখরাবাদ। এলাকাবাসীর আশঙ্কা, মানচিত্র থেকেই মুছে যেতে পারে একাধিক গ্রাম।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, ‘এই জমি তো এমনিতেই গঙ্গায় তলিয়ে যাবে, এমন যুক্তি দেখিয়ে জমির মালিকদের সামান্য টাকার বিনিময়ে রাজি করানো হচ্ছে মাটি কাটতে। কিন্তু ঠিকাদাররা কোথাও থেকে মাটি আনছে না, শুধু এখানেই কাটছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা দেবাশিস বৈদ্য বলেন, ‘এটা তো খাল কেটে কুমির নিয়ে আসছে জেলা সেচ দপ্তর ও জেলা প্রশাসন। মানুষের কথা চিন্তাই করছেন না তারা।’ তবে, এ বিষয়ে সেচ দপ্তরের কর্মীদের কাছ থেকে কোনও সঠিক উত্তর মেলেনি। ঠিকাদারদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। ঘটনা নিয়ে বৈষ্ণবনগরের বিধায়ক চন্দনা সরকারের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করেও সাড়া মেলেনি।
কালিয়াচক ৩ নম্বর ব্লকের বিডিও সুকান্ত শিকদার বলেন, ‘আমার কাছে এরকম কোনও খবর নেই। জেলা প্রশাসনের নির্দেশেই সেচ দপ্তর কাজ করছে। ভাঙন রোধে মাটি নয়, বালি ও পাথর দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা। আমি খোঁজ নিচ্ছি।’
গত দু’দিন ধরে ফের রতুয়া এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। তার মধ্যে শ্রীকান্তটোলা, জিতুটোলা, আমিরচাঁদটোলা, মুলিরামটোলা ও পশ্চিম রতনপুরে ভাঙন চলছে। গঙ্গাপাড়ের ৭০০ মিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। রতুয়ার বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এর জন্য কেন্দ্র দায়ী। গঙ্গার ভাঙন রোধ ওদের কাজ। কারণ গঙ্গা জাতীয় নদী। কেন্দ্রীয় সরকার সময়ে ব্যবস্থা নিলে এমন দুর্দশা হত না। যা অবস্থা, একদিন গোটা মহানন্দটোলা ও বিলাইমারি গ্রাম পঞ্চায়েতটাই নদীতে তলিয়ে যাবে।’
সম্প্রতি রতুয়ায় ভাঙন পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন মালদা উত্তরের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু। যদিও ভাঙন প্রসঙ্গে সাংসদকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘রাজ্যকে একাধিকবার বলা হলেও ভাঙন রোধের বরাদ্দ চেয়ে কেন্দ্রকে কোনও প্রস্তাব পাঠায়নি। কাজের ডিপিআর তৈরি করে দিচ্ছে না। ভাঙন প্রতিরোধের জন্য দিনকয়েক আগে লোকসভার অধ্যক্ষকে চিঠি পাঠিয়েছি। ভাঙন প্রতিরোধের জন্য আমি সবরকমের চেষ্টা চালাচ্ছি।’
গতকাল সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ করেই হরিশ্চন্দ্রপুর থানা এলাকার দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলা ফুলহর নদীর জল বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল থেকেই ইসলামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উত্তর ও দক্ষিণ ভাকুরিয়া, কাউয়া ডোল, দিয়ারা, চণ্ডীপুর, খোপাকাটি সহ একাধিক গ্রামের অসংরক্ষিত এলাকায় নদীর জল ঢুকে পড়েছে।
বেশ কয়েকটি রাস্তা সহ এলাকার অসংরক্ষিত অঞ্চলে থাকা কৃষিজমি ব্যাপকভাবে প্লাবিত। নদীর জল বেড়ে যাওয়ায় ভাঙন নিয়েও চিন্তিত স্থানীয় বাসিন্দারা। বিডিও সৌমেন মণ্ডল বলেন, ‘নদীর জল বৃদ্ধি এবং এলাকার পরিস্থিতির দিকে আমরা নজর রাখছি।’ সেচ দপ্তরের জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘ভাঙন রোধের জন্য ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হচ্ছে।’
তথ্য সহায়তা: এম আনওয়ারউল হক, শেখ পান্না ও সৌরভকুমার মিশ্র