সৌরভকুমার মিশ্র, হরিশ্চন্দ্রপুর: স্যাঁতসেঁতে ঘর। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর সেই ঘরে আবার প্রায় হাঁটুসমান জল। ঘরগুলি যেন ভেঙে জলে মেশার আশঙ্কায় দাঁড়িয়ে। অপুষ্টির স্পষ্ট ছাপ বাসিন্দাদের শরীরে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, অন্যের জমিতে দিনমজুরি খেটে দু’মুঠো ভাত জোগাড় করেন তাঁরা।
অনেকের মনে হতে পারে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে। এমন তো রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তেই দেখা যায়। কিন্তু অবাক হওয়ার আছে। আছে এ কারণেই যে, বাড়িটি গান্ধিজির সহযোদ্ধা স্বাধীনতা সংগ্রামীর। তিনি আবার প্রাকস্বাধীনতা সময়কালে রাজ্যের একজন বিধায়ক ছিলেন। মালদার (Malda) প্রথম আদিবাসী বিধায়ক বীর বিরসা ওরাওঁ থাকতেন এই বাড়িটিতে। এখন এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দু’মুঠো ভাতের জন্য লড়াই চালাচ্ছেন বিরসার বংশধররা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যাবতীয় তথ্য পোর্টালে অন্তর্ভুক্ত করতে যখন উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, তখন পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশকে মুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়া হরিশ্চন্দ্রপুরের এক আদিবাসীর পরিবারের এমন দুর্দশা, ওই উদ্যোগকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের পোর্টালে নাম উঠছে বিরসারও। দেশের বাকি অংশের মানুষ তাঁর সম্পর্কে জানবেন। জানতে পারবেন গান্ধিবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী সুবোধকুমার মিশ্রের অনুগামী বিরসা ব্রিটিশদের দেশছাড়া করতে একাধিক লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন। গান্ধিজির ডাকে আইন অমান্য, সত্যাগ্রহ থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য ব্রিটিশদের রক্তচক্ষুতে পড়ে তাঁকে জেলও খাটতে হয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৪৬ সালে প্রাকস্বাধীনতার সময়কালে অবিভক্ত বাংলায় বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য বা বিধায়ক পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন বিরসা। কিন্তু কেউ জানবে না, তাঁর পরিবারের লোকেরাই বর্তমানে অন্ধকারে। কোনওরকমে দিনমজুরি খেটে জুটছে দু’মুঠো ভাত। কেননা, এসব কথা পোর্টালে লেখা হবে না।
‘কেউ কথা রাখেনি’, লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘একা এবং কয়েকজন’ কাব্যগ্রন্থটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৭৭ সালে। ৪৮ বছর পরেও প্রাসঙ্গিক ‘কেউ কথা রাখেনি’। রাখলে আশ্চর্যজনকভাবে হরিশ্চন্দ্রপুর তেঁতুলবাড়ি মোড় থেকে তাঁর নামফলকটি উধাও হত না। হরিশ্চন্দ্রপুরজুড়ে থাকা এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্মৃতিচিহ্নগুলি মুছে যেত না। যে কারণে বর্তমান হরিশ্চন্দ্রপুরের সিংহভাগ বাসিন্দা তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। বিরসা ওরাওঁয়ের নামই শোনেনি নতুন প্রজন্ম। পরিবারটির ভাগ্য ভেসেছে বানের জলেও। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে পাওয়া তাম্রফলকটি ২০১৭ সালে বন্যায় ভেসে যাওয়ায় পরিবারটির হাতে সম্বল বলতে কিছুই নেই। দারিদ্র্যের জ্বালায় বিরসার কবরস্থানটিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে পরিবারটি। এখন সেখানে বহুতল।
এখানেই কথা হল বিরসার নাতবৌ বৃদ্ধা চাঁদবতী ওরাওঁয়ের সঙ্গে। বিরসা বিধায়ক ছিলেন, শুনেছেন। বললেন, ‘চেহারাটা আবছা আবছা মনে আছে।’ বিরসার বাড়িতে এখন থাকেন চাঁদবতী ছাড়াও তাঁর ছেলেমেয়েরা। প্রত্যেকেই দিনমজুর। এমনই একজন সানি ওরাওঁ বললেন, ‘শুনেছি এমএলএ ছিলেন। এর বেশি কিছু জানি না।’ সরকারি সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত, বিরসার উত্তরসূরিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে। যা জেনে হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকের বিডিও (BDO) সৌমেন মণ্ডল বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী বিরসা ওরাওঁ এবং তাঁর পরিবারের কথা আমার জানা ছিল না। আমি খোঁজ নিচ্ছি। সমস্তরকম সরকারি সাহায্য পরিবারটির হাতে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ উত্তর মালদার সাংসদ খগেন মুর্মু আবার রাজ্য সরকারের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছেন। বলছেন, ‘জেলার অন্যতম আদিবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবারের এমন অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। রাজ্য সরকার কেন কোনও পদক্ষেপ করেনি, এটাই আমার প্রশ্ন।’ সমস্ত নথিপত্র সংগ্রহ করে বিরসার পরিবার যাতে কেন্দ্রীয় সুযোগসুবিধা পায়, সেই চেষ্টা তিনি করবেন বলে আশ্বাস সাংসদের।
সমস্তটাই জানেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী সুবোধকুমার মিশ্রের ছেলে অধ্যাপক সমরকুমার মিশ্র। বলছেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি বাবার কাছে আসতে। বৃদ্ধ বয়সেও যথেষ্ট ডাকাবুকো ছিলেন। কিন্তু অনুতাপের বিষয়, আজ হরিশ্চন্দ্রপুরের মাটিতে তাঁর কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই।’
কেউ কি কথা রাখবে?