রণজিৎ ঘোষ, তিনধারিয়া : ধসে শুধু রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, মার খেয়েছে ব্যবসা। ১১০ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সমতল থেকে দার্জিলিংয়ের মধ্যে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়নি আজও। অথচ এই রুটের ওপর কয়েকশো মানুষের রুজিরুটি নির্ভরশীল। সড়কের পাশে একের পর এক দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ থেকে গ্যারাজ খুলেছে একসময়। সেই থেকে আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন বাসিন্দারা। রমরমা ব্যবসা হত। সবসময় ভিড় লেগে থাকত পর্যটকদের।
২০১২ সালে তিনধারিয়ায় বড় ধসের পর থেকে ছবিটা বদলাতে শুরু করে। তারপর একাধিকবার ধসের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই রাস্তা। মেরামতও হয়েছে। তবে আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি সড়কের হাল। চুনাভাটিতে চায়ের দোকান রয়েছে সুপর্ণা তামাংয়ের। আক্ষেপের সুর তাঁর গলায়, ‘এখন দিনে ৫০০ টাকারও ব্যবসা হয় না। অথচ একসময় ৩০০০ টাকা অবধি বেঁচাকেনা হত। অনেক ট্রাক, বাস আর চারচাকার ছোট গাড়ি দাঁড়াত দোকানে। চালক, পর্যটকরা চা ও জলখাবার খেতেন। অন্য দোকান থেকেও কেনাকাটা করতেন। এখন তো দু’তিনটে বেসরকারি বাস ছাড়া কিছুই তেমন চলে না।’
কিছু জায়গায় টয়ট্রেনের লাইন নতুন করে পাততে গিয়ে আরও সরু হয়েছে সড়ক। সেদিক দিয়ে দুটো গাড়ি পাশাপাশি চলা মুশকিল। তাই যানবাহনের সংখ্যা কমেছে স্বাভাবিকভাবে। স্থানীয়রা চাইছেন, তাঁদের রুজিরুটির কথা ভেবে জাতীয় সড়ক দিয়ে আগের মতোই গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হোক। পালটা কার্সিয়াংয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক রায়ের বক্তব্য, ‘জাতীয় সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচলে কোনওরকম নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে, কয়েকটি জায়গায় পরিস্থিতি খারাপ। সেখানে কাজ চলছে। যে কোনও গাড়ি ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে পারে।’ দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু বিস্ট ধোঁয়াশা বজায় রেখে বললেন, ‘হিলকার্ট রোড নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। সময় হলে জানাব।’
২০১২ সালের জুলাইয়ে তিনধারিয়ায় টয়ট্রেনের ওয়ার্কশপের নীচ দিয়ে যাওয়া ১১০ নম্বর (পুরোনো ৫৫ নম্বর) জাতীয় সড়কে প্রায় ২০০ মিটার জায়গাজুড়ে রাস্তা ধসে গিয়েছিল। পাশ দিয়ে যাওয়া টয়ট্রেনের ট্র্যাক শূন্যে ঝুলতে দেখা যায়। ঘটনার জেরে এই পথে যানবাহন এবং টয়ট্রেনের চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। পরের বছর পাগলাঝোরায় একইভাবে ধস নেমেছিল। ঝুঁকি এড়াতে ধীরে ধীরে অধিকাংশ যানবাহন রোহিণী রোড হয়ে শিলিগুড়ি থেকে কার্সিয়াং, দার্জিলিং রুটে চলতে শুরু করে।
একসময় দার্জিলিংগামী এই জাতীয় সড়ককে কেন্দ্র করে সুকনা, রংটং, চুনাভাটি, তিনধারিয়া, গয়াবাড়ি, মহানদী, পাগলাঝোরা সহ বহু গ্রামের মানুষের রুটিরুজির জোগান হত। দিনরাত প্রচুর সংখ্যক পণ্যবাহী গাড়ি, যাত্রীবাহী সরকারি-বেসরকারি বাস, পর্যটকদের গাড়ি চলত। রংটংয়ে ট্রাক সিন্ডিকেটের কর্মী তিনধারিয়ার বাসিন্দা অশোক সুনদাস বলছিলেন, ‘ক্রেতার অভাবে দোকান, হোটেলগুলো পরপর বন্ধ হতে শুরু করল। কাজের খোঁজে এলাকাবাসীকে পাড়ি দিতে হল ভিনরাজ্যে। তাঁরা এখন বেঙ্গালুরু, দিল্লিতে কাজ করছেন।’
মঙ্গলবার রংটং, তিনধারিয়া, চুনাভাটি ও পাগলাঝোরায় গিয়ে চোখে পড়ল, ঝাঁ চকচকে জাতীয় সড়ক তৈরি হয়েছে। পাশের গার্ডওয়ালে রংয়ের প্রলেপ পড়ছে। তবে, পাগলাঝোরা থেকে মহানদী পর্যন্ত রাস্তার অনেকটা অংশ উঁচু করে টয়ট্রেনের লাইন পাতায় সড়ক চওড়ায় কমে গিয়েছে। জাতীয় সড়কের ধারে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যানবাহন চোখে পড়ল না। খাঁ খাঁ করছে চারপাশ। অশোকের কথায়, ‘৩০ বছর ধরে কাজ করছি। এখানকার পরিস্থিতি দেখলে খারাপ লাগে।’