অনুপ সাহা, চুইখিম: উন্নয়নের নামে নির্বিচারে গাছ ও পাহাড় কাটার ফলে দেশি-বিদেশি অসংখ্য প্রজাতির পাখি ও প্রজাপতি মুখ ফিরিয়েছে চুইখিম (Chuikhim) থেকে। মাত্র ৬ বছর আগেও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৫০০ ফুট উচ্চতায় চুইখিম নামে যে পাহাড়ি নিরিবিলি গ্রামটি ছিল প্রায় ১২৫ প্রজাতির পাখির নিরাপদ আস্তানা, সেটাই আজ পরিণত হয়েছে ইট-পাথর-সিমেন্টের জঙ্গলে।
নতুন ৭১৭ এ জাতীয় সড়ক নির্মাণের ফলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে কালিম্পং পাহাড়ের দক্ষিণ অংশে চুইখিম-বরবট-নিমবংয়ের মতো পাহাড়ি গ্রামগুলোতে। ভঙ্গুর পাহাড় ও হাজার হাজার গাছ নির্বিচারে কেটে তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় লুপ পুল (Loop Pool) সহ দুই লেনের মসৃণ পিচঢাকা সড়ক। আঁকাবাকা পথে যানবাহনের সংখ্যা ও গতি দুই-ই বেড়েছে। উন্নয়নের এহেন স্পর্শ স্বাভাবিকভাবেই পছন্দ হয়নি পক্ষীকুলের। একসময় যে পাহাড়ি গ্রামটি বার্ড ওয়াচারদের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাতিলাভ করেছিল, সেখানে এখন রংবেরংয়ের পাখিদের দেখা মেলাই ভার।
অজয় গুরুং নামে চুইখিমের একজন বার্ড ওয়াচার বলেন, ‘কয়েক বছর আগে এখানে হিমালয়ান বুলবুল, ক্রিমসন সানবার্ড, ব্লু হুইসলিং থ্রাশ, গোল্ডেন ব্যাবলার, গ্রেট হর্নবিল সহ আরও অসংখ্য প্রজাতির বহু পাখির দেখা মিলত। পাখিদের টানেই এখানে ছুটে আসতেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বার্ড ওয়াচাররা। কিন্তু ইদানীং পাখির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে চুইখিম সহ পাহাড়ের এই প্রান্তে।’ হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)-এর মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, ‘সড়ক নির্মাণের জন্য যেভাবে হাজার হাজার গাছ, লতা, গুল্ম কেটে সাফ করে দেওয়া হয়েছে তার ফলে শুধুমাত্র পাখিরাই নয়, বাস্তুতন্ত্রের উপযোগী বহু ধরনের কীটপতঙ্গ, প্রজাপতির সংখ্যাও ব্যাপকহারে কমে গিয়েছে চুইখিম থেকে। ফ্লাই ক্যাচার, লাফিং থ্রাশ, রেড হেডেড ট্রোগন, নাটহ্যাচ সহ মোট ১২৫টি প্রজাতির পাখির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল চুইখিমে।’ এখন তারা সংখ্যায় অনেক কমে এসেছে বলে অনিমেষের দাবি।
একই বক্তব্য আরেক বার্ড ওয়াচার ডাঃ কৌস্তভ ভৌমিকেরও। একসময় চুইখিমে নিয়মিত দেখা যেত হোয়াইট ক্যাপড রেডস্টার্ট, লিফ বার্ড, ওরিয়েন্টাল হোয়াইট আই, কালিজ ফিজ্যান্ট ও বিভিন্ন ধরনের কাঠঠোকরা। তাদের তালিকা তুলে ধরে কৌস্তভবাবু বলেন, ‘গত দু-তিন বছরে এই পাখিদের একেবারেই দেখা মেলেনি চুইখিমে।’
অন্যদিকে, পাখিদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বিরল প্রজাতির প্রজাপতিরও অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে চুইখিমে। গত ১৮ বছর ধরে চুইখিমে প্রজাপতিদের টানে বারবার ছুটে এসেছেন কলকাতার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রিনা সিং। এদিন তিনি বলেন, ‘সাধারণত জঙ্গলের চরিত্র কেমন তা বোঝাতে প্রজাপতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে যত বেশি সংখ্যায় ও প্রজাতির প্রজাপতির দেখা পাওয়া যায়, সেই জঙ্গল ততটাই ভালো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, সড়ক তৈরির কাজে হাজার হাজার গাছ কেটে সাফ করে দেওয়ার ফলে প্রজাপতিদের নেকটার প্ল্যান্ট (খাবারের জন্য) এবং হোস্ট প্ল্যান্ট (ডিম পাড়ার জন্য) সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যে কারণে প্রজাপতির ৩০-৪০টি প্রজন্ম হারিয়ে গিয়েছে। প্যারিস পিকক, গর্গনের মতো বিরল প্রজাতির প্রজাপতির পাশাপাশি টিংশেল, পানচ, গ্রিন ফ্ল্যাশ নামে প্রজাপতিকুলের কোনও অস্তিত্ব গত দু’বছরে খুঁজে পাওয়া যায়নি চুইখিমে।
চুইখিমে পাখি ও প্রজাপতিদের অস্তিত্ব সংকটের কথা মানছেন বনকর্তারাও। কালিম্পং বন বিভাগের ডিএফও চিত্রক ভট্টাচার্য বলেন, ‘এটা অনস্বীকার্য যে সড়ক নির্মাণের ফলে চুইখিমের পাখি ও প্রজাপতির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। নির্মাণকারী সংস্থার তরফে ইতিমধ্যেই পাহাড়ি এই পথে নতুন করে প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। তবে সেগুলো বড় হতে সময় লাগবে নিদেনপক্ষে দশ বছর। আমরা আশাবাদী আবার পাখি ও প্রজাপতির দল চুইখিমে ফিরবে।’
বাস্তবে, বাগ্রাকোট থেকে লোলেগাঁও পর্যন্ত নতুন ৭১৭ এ জাতীয় সড়কের ৪১ কিলোমিটার অংশে যে হারে গাছ কাটা হয়েছে তার বিনিময়ে নতুন করে চারাগাছ রোপণ করার কাজও করেছে ন্যাশনাল হাইওয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড। জাতীয় সড়কের ধারে যে যে অংশে জমি রয়েছে সেখানেই বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য চারাগাছ রোপণ করা হয়েছে বলে দাবি এনএইচআইডিসিএলের। তা সত্ত্বেও পরিবেশের যে ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে তা পূরণ করতে যে আরও কয়েক দশক লাগবে সে বিষয়ে নিশ্চিত সকলেই। ততদিন পাখি আর প্রজাপতিরা ফিরবে না তাদের পুরোনো ঠিকানায়।