বালুরঘাট: সকাল তখন কটাই বা হবে। সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা। শহরের বিভিন্ন এলাকায় জুসের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে কয়েকজন। কিছু দোকানে এই জুস কিনতে কার্যত ভিড়ও হতে দেখা যাচ্ছে বালুরঘাটে (Balurghat) । কাছে যেতেই জানা গেল এটি পরিচিত মৌসম্বী বা বেদানার জুস নয়। এটি নাকি গাছগাছালির জুস। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলতেই উঠে এলো আক্ষরিক অর্থেই প্রচুর ভেষজ উদ্ভিদের নাম।
বালুঘাট শহরের তিন জায়গায় সকাল হলেই দোকান বসছে নানা ভেষজ উদ্ভিদের এই জুসের। থাকছে আমলকি, বহেরা, হরিতকি , অশ্বগন্ধা, অর্জুন, বেল, ইসবগুল সহ আরও কত কী। অ্যালোভেরার সঙ্গে মিশিয়ে পান করছেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। গরম থেকে রেহাই পেতে ও নীরোগ থাকতে শহরবাসী বেছে নিচ্ছেন এই পন্থা। শুধু সকালে কয়েক ঘন্টা বসেই প্রায় ২০০ গ্লাস বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এই জুস (Juice)। দাম রাখা হয়েছে গ্লাস প্রতি ১০-১৫ টাকা। ইতিমধ্যেই শহরবাসীর মধ্যে এটি এলোভেরা জুস নামেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে এই জুসে শুধু এলোভেরা নয়, তাতে থাকছে ২০ টিরও বেশি ভেষজ উদ্ভিদের মিশ্রণ। শহরের স্বাস্থ্য সচেতন কিছু মানুষ রোজ সকালে খেয়ে যাচ্ছেন এক গ্লাস সি ঔষুধি পানীয়। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দূর করতে মানুষ এখন আয়ুর্বেদিক উপকরণের দিকে ঝুঁকছে। সরকারের তরফেও আয়ুর্বেদিক, ইউনানী চিকিৎসার উপরে যথেষ্ট জোর দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্র সরকার আয়ুষ প্রকল্পের মাধ্যমে ভেষজ উদ্ভিদ চিহ্নিতকরণ ও সেগুলির গুণাবলী প্রচার করছে। ঠিক তখনই শহরবাসী গাছের ছাল, মূল, পাতা ইত্যাদির মধ্যে নীরোগ থাকার রসদ খুঁজছেন। সকাল হতেই বালুরঘাটের থানা মোড়, বিশ্বাসপাড়া, পুরসভার সামনের এলাকায় দেদারে বিকোচ্ছে বনৌষধি জুস।
কামারপাড়া থেকে এসে পুরসভার সামনে বসা বিক্রেতা পলাশ বর্মনের কথায়, ‘আগে গ্রামে এগুলো নিয়ে বসতাম। এখন শহরবাসীর মধ্যে চাহিদা বাড়ায় এখানে বিক্রি করছি। আমার মামা বাংলাদেশ থেকে এই পদ্ধতি শিখে এসে বাবাকে শিখিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি এই পেশায় ছিলেন। তারপর আমি হাল ধরেছি। ওই দেশে ভেষজ উদ্ভিদের এই মিশ্রণের জুস প্রচুর জনপ্রিয়। এখানে এটি ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।’
তপনের অভিরামপুর থেকে বিশ্বাস পাড়ায় দোকান দেওয়া দশরথ হালদার জানান, ‘বাবা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করতেন। তার কাছ থেকেই শেখা। এখন শরীর সুস্থ রাখতে অনেকেই চিয়া সিড খাচ্ছেন। ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন সমৃদ্ধ সেই উপকরণও আছে। ত্রিফলার গুণ সকলেরই জানা, সেটিও আছে। এখানে যত রকমের উদ্ভিজ্জ ঔষধি আছে। তা দিয়ে ৭২ রোগের নিরাময় সম্ভব।’
ভারিলা গ্রামের বিকাশ হালদার বসছেন থানা মোড়ে। তিনি বলেন, ‘পরিবার সূত্রে ভেষজ উদ্ভিদ চেনা ও সেগুলির গুণাবলী জেনেছি। বাড়িতে পাঁচ কাঠা জায়গার উপরে ঘৃতকুমারী ও শিমুলের গাছ লাগানো আছে। আমার কাছে ২২ ধরনের ভেষজ উদ্ভিদ মজুত আছে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ খানেক গ্লাস বিক্রি হয়। তবে করোনার বাড়বাড়ন্তের সময় বেশি বিক্রি হতো। এখন কিছুটা কমে এসেছে।’
উপকরণ ও গুণাবলী: এই জুসের মূল উপকরণ অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী। যা নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজের এক সমৃদ্ধ উৎস। অল্পসংখ্যক উদ্ভিদের মধ্যে ঘৃতকুমারী একটি যাতে ভিটামিন বি-১২ আছে। প্রায় ২০ ধরনের খনিজ আছে ঘৃতকুমারীতে। পাশাপাশি, শরীরের শর্করা কমিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণ ও কৌষ্ঠকাঠিন্য নির্মূল করতে তোকমা, ইসবগুলের ভুসি, তাল মাখনা। পেটের সমস্যা, বাত সারাতে ও রক্তের শুদ্ধির জন্য কুটজা, যা লিভার ভাল রাখে। বলকারক হিসেবে শিমুলের মূল। শারীরিক সমস্যা মেটাতে বেল, আমলকি, হরতকি, বহেরা। উচ্চ রক্তচাপ কমাতে কাতিলা, সোনা পাতা। রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে চিরতার জল, যা ডায়াবেটিসের মাত্রা কমায়। আমাশয় রোধে উলট কম্বল। হৃদরোগ আটকাতে অর্জুন গাছের ছাল। মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখতে আলতুসি। স্নায়ু সমস্যা, দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপের কারণে উদ্ভূত অবসাদ কমাতে অশ্বগন্ধা। সবশেষে স্বাদের জন্য হিম তুলসী ও আঁখের গুড়।