হাতে বোনা সময়…

হাতে বোনা সময়…

শিক্ষা
Spread the love


  • উমাদাস ভট্টাচার্য

       কারও কারও সঙ্গে দেখা হ‌ওয়ার কথা থাকে না। অথচ দেখা হয়। আর এইসব দেখা হ‌ওয়ার কোনও প্রস্তুতি থাকে না। আবার কারও কারও সঙ্গে দেখা হবেই জানা থাকে। দেখা হলেই কথা হবে এমন নয়, আবার কথা থাকলেও দেখা হয় না এমন‌ও হয়েছে কতবার। আজ যেমন স্কুটারটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ানোর আগেই নিজের নামটা কানে আসতে ব্রেকে হাত পড়ল অরূপের। উলটোদিকের বাড়ির সামনে ছায়া ছায়া গোল গোল ভিড়। এখন শহরে খুব একটা জ্যোৎস্না নেমে আসে না কারও মুখে। দু’পাশের উঁচু উঁচু বাড়ি চাঁদকে সরিয়ে দেয়। ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোয় অরূপ দেখে একটা লাইট ট্রলিব্যাগ ঘিরে উলটোদিকের বাড়িশুদ্ধ মানুষ দরজার গোড়ায়। তার মধ্যে থেকেই ভেসে এল আর একবার

—অরূপ… অরূপ…

অরূপ স্কুটারটা স্ট্যান্ড করে। নেমে আসে। এই সময় এই শহরে বাড়ির বাইরে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে আসা কিংবা মোড়ের মাথায় টোটোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মানে গৌড় এক্সপ্রেসের সময় হয়েছে। ইদানীং বালুরঘাট-শিয়ালদা। এসময় শহরের সমস্ত অলিগলি রাজপথজুড়ে ছুটে চলা অজস্র টোটো অটো কালো কাচে ঘেরা গাড়ি পায়ের কাছে পেটের ভেতর কিংবা মাথায় থাক থাক ট্রলিব্যাগ নিয়ে ছুটে যায়। গৌড় এক্সপ্রেস থেকে নামতে গিয়ে অথবা উঠতে গিয়ে কতদিন বাদে বাদে চেনা জনের সঙ্গে দেখা হয় এ শহরের মানুষের। এক শহরে থেকেও। সারারাত পার হয়ে শিয়ালদা স্টেশনে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়। এই ট্রেন থেকে নামা সারি সারি মানুষের মিছিলে চিরদিন কাউকে না কাউকে পেয়ে যায় অরূপ। অরূপ জানতে পারে ওরা শহরেই ছিল। দেখা হয়নি। কথা হয়নি।

শিয়ালদা স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভিড়ে কখনও দু’বার এক‌ই ক্লাসে ফেল করা অনিরুদ্ধ থাকে। কখনো-কখনো হঠাৎ ক্লাস টেন-এ উঠে টিসি নিয়ে কলকাতায় চলে যাওয়া স্মরজিৎ থাকে। ঘুম ঘুম চোখে কখনও পাশাপাশি কখনও আগে পরে। অনিরুদ্ধর তুলনায় অরূপরা শিশু ছিল। অনিরুদ্ধ ওদেরকে দিয়ে যখন যা খুশি করাতে পারত। অনিরুদ্ধর হাত ধরে নাকি পেছন পেছন ওরা স্কুল পালিয়ে সীমানার বাইরে নিষিদ্ধ বট গাছের নীচে এসে দাঁড়াত। একটু বড় ক্লাসে উঠতেই বট গাছ পেরিয়ে মন্দির পেরিয়ে স্কুল আড়াল হলেই অনিরুদ্ধর হাতে উঠে আসত উডবাইন সিগারেট। ওরা নিষিদ্ধ জগতের চৌমাথায় এসে দাঁড়াত। অনিরুদ্ধর চোখে সম্মোহন ছিল। ওর কাঁধ বুক চোয়াল এক নিমেষে দিগন্তব্যাপী হয়ে উঠত। নিজেদের ভীরু খরগোশ মনে হত অনিরুদ্ধর সামনে।

এখন শহরের যে কোনও মোড়ে সবার সামনে সিগারেট ধরিয়ে যখন হেলায় রাস্তা পার হয় অরূপ, তখন শরীরে সেই উত্তেজনাই বা কোথায়, আর অনিরুদ্ধ‌ই বা কোথায়। অনিরুদ্ধ দু’দুবার এক‌ই ক্লাসে ফেল করে কোথায় কোন স্কুলে গিয়েছিল ওরা জানে না। অনেকদিন পর শিয়ালদা স্টেশনে গৌড় এক্সপ্রেস থেকে নেমে এক‌ই প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরোতে গিয়ে হঠাৎ পাশাপাশি হয়েছিল। দুজনে দুজনকে অবশ্যই চিনেছিল। চিনতে না পারলে চোখাচোখি হয় চোখের মণিতে মণিতে আটকে তো যায় না। কয়েক মুহূর্ত। গেটে চেকারকে টিকিট দেখাতে গিয়ে অনিরুদ্ধকে হারিয়ে ফেলেছিল অরূপ।

—-অনি তুই তো একটু দাঁড়াতে পারতিস

—-তুই তো একটু তাড়াতাড়ি করতে পারতিস অরূপ

—-আসলে তুই কেটে পড়বি ভেবে

—-ধুর … স্পষ্ট দেখলাম তুই ইচ্ছে করে টিকিট দেখাতে দেরি করছিস

কাল্পনিক সংলাপে তারপরেও বেশ কিছুদিন আচ্ছন্ন ছিল অরূপ। যতবারই গৌড় এক্সপ্রেস থেকে শিয়ালদা স্টেশনে নামে অনিরুদ্ধকে দেখতে পাবে ভাবে অরূপ। স্কুল বিল্ডিং কিংবা নিজের শহর থেকে অনেক দূরে, গৌড় এক্সপ্রেস থেকে নেমে শিয়ালদা স্টেশনে অরূপের একটা ইচ্ছে গাছ পুঁতে দিয়েছে অনি। ইচ্ছে গাছটার তলায় স্মরজিৎকে দেখতে ইচ্ছে করে অরূপের। ক্লাস টেনে উঠে স্মরজিৎ ট্রান্সফার নিয়ে চলে গিয়েছিল কলকাতায়। সেদিন ব‌ইখাতা কিছুই আনেনি। ও কোনও ক্লাস‌ও করেনি। সবাই হঠাৎ জেনেছিল। সবাই থমকেও দাঁড়াচ্ছিল। তারপর থেকে যাওয়া বাকিরা দলবেঁধে থোকা থোকা হয়ে হুল্লোড়ে মেতে যাচ্ছিল। শুধু কোনও কারণ ছাড়াই অরূপ ওর সঙ্গে ঘুরেছিল সারাদিন। বিষণ্ণ তাড়াহীন স্মরজিৎ ঘুরছিল স্কুল বারান্দায়। প্রেয়ারের মাঠে। নোটিশ বোর্ডের সামনে অযথাই কাঠের ফ্রেমের তারজালির মধ্যে দিয়ে ধূসর প্রাগৈতিহাসিক আঠা শুকিয়ে অর্থহীন দোদুল্যমান নির্দেশনামা দেখছিল। ক্লাস শেষ হয়ে বিকেল গড়িয়ে হেডস্যরের জন্য অপেক্ষা করেছিল ওরা। বিকেল গড়িয়ে স্কুলের ভারী থাম খোলা দরজার ভিতর দিয়ে স্মরজিৎ একা একাই খালি বেঞ্চগুলো দেখছিল সেদিন। অরূপের মনে হচ্ছিল স্মরজিৎ একা একা স্কুলটার সঙ্গে কাটাতে চাইছিল।

—-তোর বাবা আসেনি কেন?

অরূপের কথায় স্মরজিৎ মাটির দিকে তাকিয়ে বলেছিল

—-নেই

—-মানে?

অরূপ আসলে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারেনি, বাবা মারা গেছে কি না

—-না… মানে নেই… থাকে না আমাদের সঙ্গে…

—-মা?

—-কলকাতায় থাকে…একা…

—-সেখানেই যাচ্ছিস?

—-না…

—-তবে কোথায় যাবি? কার কাছে?

ভিতরে ভিতরে অরূপ ভয়ে আক্রান্ত হচ্ছিল। সেদিন স্মরজিৎ চলে যাওয়ার আগে ওই বয়সে যেটুকু বলা যায় বলেছিল। সারা স্কুল বিল্ডিং ঘুরে ঘুরে হেডস্যরের ঘরে ঢুকে টিসি নেওয়ার আগে স্মরজিৎ যা বলেছিল তার মানে তখন যা বুঝেছিল অরূপ সবার বাবা-মা ভালো হয় না। স্মরজিৎ শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়েছিল, কার কাছে গিয়েছিল, অরূপ আজ‌ও জানে না। শুধু শিয়ালদা স্টেশনে নামলে একবার ইচ্ছে গাছটার দিকে তাকায়। আর তাকালেই দেখতে পায় শেষ বিকেলের অন্ধকারে স্মরজিৎ বিশাল স্কুল বিল্ডিংটায় একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর অরূপ চিৎকার করে ডাকছে স্মরজিৎকে কিন্তু গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। আসলে যখন যাকে দেখতে চায় অরূপ, কথা বলতে চায়, শিয়ালদা স্টেশনে এলেই তার কথা মনে হয়। আর তখনই গৌড় এক্সপ্রেস থেকে নেমে গেটের দিকে লাইন করে চলা ভোরবেলার আধো ঘুমে জোর করে চলতে থাকা নিজের শহরের লোকগুলোর মুখের ওপর চোখ বোলাতে থাকে। নিজের পাড়া থেকে নিজের শহর থেকে যারা চলে যায় তারা যেন গৌড় এক্সপ্রেসেই যায়।

অনিরুদ্ধ‌ই কি এই ধারণার চারা পুঁতে দিয়েছিল অরূপের মনে? নাকি ক্লাস টেন এ উঠে অরূপ মা বাবাকে ছাড়া প্রথমবার কলকাতায় এসেছিল বুড়ো কাকার সঙ্গে এই গৌড় এক্সপ্রেসে তাই? শীতের ভোরবেলা। ভিজে কলকাতা। উড়ালপুলহীন শিয়ালদা। রাস্তা পেরিয়ে ডিক্সন লেন হয়ে গোমেজ লেন। সুরি লেনকে বাঁয়ে রেখে সোজা মামার বাড়ি। বড় সরু গলি। সরু কলকাতা। ভরদুপুরে একা একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে একফোঁটা বোন খুব ছোটবেলায় যে গলিকে দেখিয়ে বলতো

—-দাদা জানিস ওই গলিটা ধরে সোজা গেলেই মালদা…

আসলে জীবনের কোনও গলির মোড়ে কোনও গাছের তলায় কার সঙ্গে দেখা হয় আগে থেকে জানা যায় না।

—-অরূপ… অরূপ…

ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় অরূপ উলটোদিকের বাড়িটার দোরগোড়ার ভিড়ের দিকে তাকায়। কস্তুরীদি। তখন ফেসিয়াল ছিল না। দু’কানের পাশ দিয়ে নেমে আসা ঝুমকো লতার মতো ঝুলন্ত চুল কস্তুরীদির সৌন্দর্যের একমাত্র সম্বল ছিল। কস্তুরীদি খুব ভালো ঘর মুছত। কয়লার উনুনে খুব ভালো আঁচ দিতে পারত। আর পারত শীতের ক’মাস আগে থেকে নিরন্তর হাতে সোয়েটার বুনে যেতে।

—-তোকে সবুজ সাদা খোপ খোপ ভালো লাগবে

কস্তুরীদির কথায় মা বলে উঠেছিল

—-যেমন‌ই বানা দু’তিন বছর যেন পরতে পারে

কস্তুরীদি হেসে উঠত শব্দ না করে। মামা-মামির সংসারে বাসন মাজতে গিয়েও শব্দ হলে কবে মরে যাওয়া মাকে বাবাকেও তখন নেমে আসতে হত উঠোনে। কস্তুরীদির সবকিছুই পা টিপে টিপে। অরূপ জানে। কস্তুরীদি নিজের মনেই ঘর মুছত। বাসন মাজত। সোয়েটার বুনত পাড়া শুদ্ধ লোকের। যা পয়সা পেত একটু একটু বেসন কিনত মশুর ডাল কিনত। মুখে মাখত। রিঠা কিনত মাথা ঘষবে বলে। লুকিয়ে লুকিয়ে। পা টিপে টিপে। পা টিপে টিপে চলতে চলতেই হিমাংশুদা চোখে চোখ রেখেছিল একদিন। কস্তুরীদির মামা-মামির ছেলেকে পড়াতে পড়াতে। অরূপ জানে।

—-দিয়ে আসবি?

—-আমি পারব না

—-লক্ষ্মীসোনা … আমি তোকে কত ভালোবাসি…

 মামাতো ভাইয়ের রুলটানা খাতার পাতা চুরি করে ছিঁড়ে বোকা বোকা আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় হিমাংশুদার নাম লিখে বন্ধ চিঠি দিত কস্তুরীদি। হিমাংশুদাদের ঘুমঘুম চকমেলানো প্রপিতামহের মতো ভারী দালান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির ঠান্ডা ঠান্ডা দুপুরে কোনও কোনা থেকে বেরিয়ে আসত পায়রার গম্ভীর আওয়াজ। শব্দ না করে দু’একটা গাঢ় রঙের টিকটিকি স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকত অরূপের দিকে। সাদা পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা হিমাংশুদা ঠিক বুঝতে পারত অরূপের পা টিপে টিপে আসা। হিমাংশুদা গোটা গোটা মুক্তোর অক্ষরে খামের ওপরে কস্তুরীদির নাম লিখে আঠা দিয়ে মুখ বন্ধ করে উত্তর দিত অরূপের হাতে। এসব চিঠিতে কী লেখা থাকত অরূপ জানত না। শুধু জানত এসব চিঠি দিতে হলে নিতে হলে পা টিপে টিপে চলাচল করতে হয়।

পা টিপে টিপেই একদিন হিমাংশুদা চলে গিয়েছিল কলকাতায়। সেই অনিবার্য গৌড় এক্সপ্রেসে চেপেই। আর ফেরেনি। অনেকদিন পর অরূপ শিয়ালদা স্টেশনে হিমাংশুদাকে বিকেল বিকেল রাজধানী এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন থেকে নেমে আসতে দেখেছিল। সাদা জামা সাদা প্যান্ট চোখে সানগ্লাস। হাতে চিকন অ্যাটাচি। বুকে নেমপ্লেট। কোনওদিকে না তাকিয়ে গ্রেড ওয়ান ড্রাইভার হিমাংশুদা কোথায় কোন ঘরে হারিয়ে গেল অরূপ বুঝতে পারেনি।

—-অরূপ…

জটলা ঠেলে অরূপের দিকে এগিয়ে আসে কস্তুরীদি।

—–কেমন আছ?

 হিমাংশুদা না বলে ছেড়ে যাওয়ার দু’বছর পর মামা-মামির কথায় টুঁ শব্দটি না করে একদিন এক এজমালি বাড়ির দোজবরের গলায় মালা দিয়ে গৌড় এক্সপ্রেসে উঠে বসা কস্তুরীদি চিরদিনের মতোই শব্দ না করে হেসে বলে

—-ভালো আছি। তুই?

অরূপ উত্তর দেওয়ার আগেই কেউ তাড়া দেয়

—-গৌড় ছেড়ে দেবে এরপর…

আলো আঁধারিতে জটলাটা হঠাৎ নড়েচড়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠে। অরূপের থেকে মুখ ঘুরিয়ে চলা শুরু করে। কস্তুরীদি ঢাকা পড়ে যায় ভিড়টার মধ্যে। অরূপ একটা সবুজের ওপর সাদা খোপ খোপ সোয়েটার খুঁজে চলে প্রাণপণে। বহু দূরের একটা স্টেশনে একটা ইচ্ছে গাছের নীচে কারা কারা সব জড়ো হচ্ছিল তখন। অনেকদিন বাদে বাদে এ শহরের অনেক চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ওখানে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *