- পূর্বা সেনগুপ্ত
আমরা দেবালয়ের সন্ধানে বহু পথ অতিক্রম করেছি। এই পরিক্রমায় আমাদের কাছে বঙ্গসমাজে শ্রীচৈতন্যের প্রভাবকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। বহু দেবালয়ের ইতিহাস বর্ণনায়, সমভাবে গৃহপ্রাঙ্গণে দেবারাধনার প্রসঙ্গে অনেক পরিবারে শ্রীচৈতন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। এরই সঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেব দক্ষিণ ভারত ও উড়িষ্যার আধ্যাত্মিক ভাবনার সঙ্গে বঙ্গভূমিকে যে সংযুক্ত করেছিলেন তারও একটি স্পষ্ট আভাস আমরা পাই।
বাংলায় বৈষ্ণব আন্দোলন সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে প্রভু নিত্যানন্দ সমভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আজ আমরা প্রভু নিত্যানন্দের জন্মস্থান বীরভূমের একচক্রা গ্রামের এক পরিবারের কাহিনী বর্ণনা করব, যে পরিবারের গৃহদেবতা শ্রীচৈতন্য পূর্ববর্তী যুগ থেকে আরাধিত। আমরা বৈষ্ণবাচার্য রসিকমোহন বিদ্যাভূষণের কথা বলছিলাম।
১২৫৬ সালে বীরভূমের একচক্রা গ্রামে, যে গ্রামে প্রভু নিত্যানন্দের জন্ম সেই পবিত্র স্থানে জন্মগ্রহণ করেন রসিকমোহন বিদ্যাভূষণ। যে পরিবারে রসিকমোহন জন্মগ্রহণ করেন সেই পরিবার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু জন্মের আগে থেকেই বৈষ্ণব ভাবধারায় স্নাত ছিল। আমরা দেখি এঁরা ছিলেন সর্বানন্দী মেল- অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের বংশ, তাঁর সন্তান স্বরূপ। বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে এঁদের সংস্রব অনেক আগে থেকেই ছিল। দাক্ষিণাত্য থেকে প্রথম বৈষ্ণব ভাবনার প্রভাব বঙ্গভূমিতে আসতে শুরু করে তখন বাংলায় বৈষ্ণব সাত্বত, ভাগবত বা পাঞ্চরাত্র ভাবনার অস্তিত্ব ছিল। এঁরা মূলত শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন এবং গুরু হয়ে দীক্ষাপ্রদান করতেন।
শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর পার্ষদ শ্রীনিবাস আচার্যপ্রভুর নয়জন ঊর্ধ্বতন বংশধর ছিলেন কুমুদ চট্টরাজ। তিনি তাঁর কন্যা শ্রীমতী কৃষ্ণপ্রিয়া দেবীকে রসিকমোহনের পরিবারে বিবাহ প্রদান করেন। সেই সূত্রে এই পরিবার বৈষ্ণব সমাজে আরও কৌলীন্যের অধিকারী হয়। এই পরিবারে চিরকাল অধিষ্ঠিত শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ পরিবারটির পরিচালকরূপে বিরাজ করেছিলেন।
ঠিক কবে এই গৃহদেবতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তার সময় নির্দেশ করা সম্ভব হয়েছে। সেই ক্ষণ থেকে আমরা আমাদের আলোচনার বিস্তার করব। তাই এই পরিবারের লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টরাজের বা চক্রবর্তীর কাহিনী দিয়ে পারিবারিক ইতিহাস শুরু করব। এর মাধ্যমে তৎকালীন সামাজিক ইতিহাসও অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টরাজের পিতা ছিলেন অনন্তরাম চট্টরাজ। তিনি একাধারে রাজার মতো ধনী ছিলেন। লোকে রাজচক্রবর্তী উপাধি প্রদান করে তাঁকে সম্মানিত করেছিল। অন্যদিকে তিনি পণ্ডিতও ছিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণকে তিনি পাণিনির ব্যাকরণ অধ্যয়ন করিয়ে প্রথমে বারাণসীতে পাঠান বেদ-বেদান্ত অধ্যয়নের জন্য। এরপর বৃন্দাবনে পাঠান ভক্তিশাস্ত্র শিক্ষার জন্য।
তখন তীর্থগুলি শুধু দেবার্চনার স্থান ছিল না, তার সঙ্গে শাস্ত্রপাঠেরও কেন্দ্র ছিল। লক্ষ্মীনারায়ণ সেখানে উপস্থিত হয়ে কেবল ভক্তিশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন না, ভক্তিরসে টইটুম্বুর হলেন। তাঁর হৃদয়ে প্রবল বৈরাগ্য দেখা দিল। তিনি সংসারে বদ্ধ হতে চাইলেন না। পুত্রের মানসিক অবস্থা দেখে পিতা অনন্তরাম অত্যন্ত চিন্তায় পড়লেন। তাঁর এত ধনসম্পত্তি, সেগুলোর কী হবে, যদি পুত্র সংসারী না হয়? তিনি লক্ষ্মীনারায়ণকে ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য রওনা হলেন বৃন্দাবনে। সেখানে পুত্রের সঙ্গে দেখা হলে তিনি তাঁকে ঘরে ফিরে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করতে শুরু করলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁর পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আপনি বাবা, আপনি জনক, পরম স্নেহময়। ঘরে পরম স্নেহময়ী জননী আছেন। এই দেহ আপনাদের সৃষ্ট। আমি ঘরে বসে আপনাদের সেবা করতে পারলে সুখী হতাম, কিন্তু শ্রীগোবিন্দ আমার জন্য সুখের ব্যবস্থা করেননি। উদাসীন হয়ে দেশে দেশে ঘুরে আমাকে তাঁর কথা প্রচার করতেই হবে। কিন্তু আপনি আমার শুধু পিতা নন, আমার গুরুও। বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত মন্ত্র আমাকে প্রদান করেছেন। আপনি যদি আমাকে অনুমতি প্রদান না করেন তবে আমি নিজেকে ঈশ্বর চরণে সমর্পণ করতে সক্ষম হব না। আপনি আমায় অনুমতি দিয়ে কৃতার্থ করুন।’
অনন্তরামও ভক্ত ছিলেন। তিনি অশ্রুজলে সিক্ত কণ্ঠে পুত্রকে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘শ্রীগোবিন্দ যখন এই ইচ্ছা করেছেন তবে সেই ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। কিন্তু তুমি সন্ন্যাস গ্রহণ কোরো না। যে গৌরবময় বংশে তুমি জন্মগ্রহণ করেছ সেই বংশের ধারা গোবিন্দ নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন বলে আমার বিশ্বাস। তাই তুমি ব্রহ্মচারী বেশে বিচরণ কোরো। গোবিন্দের কৃপায় যদি কোনওদিন গৃহস্থ হও তো সুখী হব।’ কিন্তু সে সুখ অনন্তরামের ভাগ্যে কখনও জোটেনি। তিনি শূন্য হৃদয়ে গৃহে ফিরে এলেন আর লক্ষ্মীনারায়ণ শ্রীবৃন্দাবন ত্যাগ করলেন। তাঁর উপাস্য রাধাগোবিন্দ যুগলকে বক্ষে ধারণ করে তীর্থভ্রমণে নির্গত হলেন।
আমরা দেখব, এই রাধাগোবিন্দ মূর্তিই পরবর্তীকালে গৃহদেবতা রূপে পূজিত হয়ে চলেছেন। লক্ষ্মীনারায়ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করার ফলে অনন্তরাম আর তাঁর কোনও খোঁজ পেলেন না। একচক্রা গ্রামের কাছে সিউড়িতে তাঁর একটি গৃহ ছিল। তিনি সেখানে শাস্ত্রপাঠ শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ইত্যাদিতে কালাতিপাত করতে লাগলেন। পুত্রের জন্য মনঃকষ্ট আরও তীব্র হয়ে উঠল, যখন পুত্রের চিন্তায় লক্ষ্মীনারায়ণের মাতা চিরতরে চোখ বুজলেন। অনন্তরাম সেই দিন থেকে সমস্ত সম্পত্তি আত্মীয়স্বজন এমনকি প্রতিবেশীদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। তারপর প্রায় পঁচাশি বছর বয়সে গোবিন্দ চরণে বিলীন হয়ে গেলেন। ভৌতিক দেহে পিতা-পুত্রের আর সাক্ষাৎ হল না।
লক্ষ্মীনারায়ণ মুক্তসঙ্গ ব্রহ্মচারী ছিলেন। তিনি গোবিন্দকে নিয়ে প্রথমে ভারতের প্রধান প্রধান তীর্থস্থানগুলি পরিভ্রমণ করতে লাগলেন। তিনি স্বপাক আহার গ্রহণ করতেন। শোনা যায়, একসঙ্গে চার-পাঁচ দিন অনাহারে থাকার শক্তি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সমুন্নতদেহ যে দেখত, তারই দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তাঁর মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িক ভাবনা ছিল না। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় তাঁকে শ্রদ্ধা করত। পরিভ্রমণ করতে করতে লক্ষ্মীনারায়ণ কোনও সময় কামাখ্যা তীর্থ দর্শনের জন্য গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফেরার সময় ময়মনসিংহ জেলার এক গ্রামে উপনীত হলেন। সেই গ্রাম তখন মুসলমান জমিদারের অধীন।
লক্ষ্মীনারায়ণ জমিদার বাড়ির কাছেই এক মাঠের মধ্যে অশ্বত্থের তলায় বসে শ্রীবিগ্রহের সেবা করছিলেন। এই সময় সেই মুসলমান জমিদার যিনি কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তাঁর অসুখ বৃদ্ধি পেয়ে প্রাণসংশয় উপস্থিত হল। চিকিৎসকগণ প্রাণের আশা ছেড়ে দিলেন। জমিদারপত্নী সম্ভাব্য বৈধব্য চিন্তা করে উন্মাদ হয়ে উঠলেন। তিনি ছাদের ওপর উঠে পূজারত লক্ষ্মীনারায়ণকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মরিয়া হয়ে গৃহের চিকিৎসককে সেই সাধুর কাছে দৈব ওষুধের জন্য পাঠালেন। চিকিৎসক লক্ষ্মীনারায়ণের কাছে এসে সমস্ত কথা ব্যক্ত করলে লক্ষ্মীনারায়ণ বললেন, ‘আমি এই বিগ্রহের সেবকমাত্র। শ্রীগোবিন্দের পূজা ছাড়া আর কিছুই জানি না। দৈব ওষুধের কথা আমাকে বলা বৃথা।’
সেই চিকিৎসক বেগম সাহেবকে এই কথা বললে বেগম চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আমাকে খোদা জানিয়েছেন, এই সাধুই আমার স্বামীর জীবনদান করতে পারবেন। যদি তিনি কৃপা না করেন, তবে আমি নিজে গিয়ে তার পায়ে মাথা কুটব।’ চিকিৎসক আবার লক্ষ্মীনারায়ণের কাছে উপস্থিত হয়ে বেগমের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ সে কথা শুনে শিহরিত হয়ে বললেন, ‘হে গোবিন্দ, তোমার কী মায়া! কী লীলা!’ আর বৈদ্যকে বললেন, ‘আমি শুধু জানি, আমার শ্রীগোবিন্দের চরণামৃত অকালমৃত্যু হরণ করে। তা সর্বব্যাধি বিনাশনং। এই চরণামৃত নতুন মাটির পাত্রে নিয়ে গিয়ে রোগীর ব্রহ্মরন্ধ্রে, দুই চোখে ও মুখে গোবিন্দের নাম উচ্চারণ করে স্পর্শ করাবেন। তাতে যদি চেতনা হয় আর রোগী কিছু খেতে চায়, তবে দুধ ছাড়া আর কিছু দেওয়া যাবে না। আর শ্রীগোবিন্দের কৃপায় যদি রোগী বেঁচে যায়, তবে যেন কোনওদিন জীবের মাংস গ্রহণ না করে।’
এই বলে লক্ষ্মীনারায়ণ জপে মগ্ন হলেন। আর চিকিৎসক গিয়ে রোগীর কপালে, চোখে, ব্রহ্মরন্ধ্রে গোবিন্দের চরণামৃত লেপন করতে লাগলেন। এইভাবে পাঁচ ঘণ্টা কেটে গেল। সেই মুমূর্ষু রোগীর দেহে প্রাণ এল। মৃতপ্রায় জমিদার যেন ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন, এমন করে বলে উঠলেন, ‘সেই সাধু কোথায় গেলেন? যিনি আমার মাথার কাছে বসে আমার জীবনদান করলেন? তিনি নিজ হাতে আমার প্রাণ দিয়ে গেলেন, দেখতে পাচ্ছ না তোমরা? তাঁর সুদীর্ঘ চেহারা, ব্রাহ্মণ, দীর্ঘ শ্মশ্রু মুখ ঢেকেছে, মাথায় জটা, সেই সোনার বর্ণ সন্ন্যাসী কোথায় গেলেন? তাঁকে একবার ধরে নিয়ে এস। আমি দর্শন করব।’
জমিদারের মুখে সন্ন্যাসীর চেহারার বিবরণ শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এ তো সেই অশ্বত্থের তলায় বসে থাকা সন্ন্যাসী। রোগীর মুখে সেই সন্ন্যাসীর কথা শুনে বেগম মূর্ছা গেলেন। দশজন লোক মিলে সেই সন্ন্যাসীর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘এক্ষুনি যেতে হবে জমিদারবাড়ি। জমিদারের জ্ঞান ফিরেছে, তিনি সাধুবাবাকে দেখতে চান।’ সে কথা শুনে লক্ষ্মীনারায়ণ বললেন, ‘ধনীলোকের অঙ্গনে পা দেওয়ার কোনও অধিকার গোবিন্দ আমাকে দেননি। আমি যেতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করবেন।’
এ কথা শুনে অনুচরেরা বলল, ‘আপনি না গেলে বেগমসাহেব আপনার পায়ে এসে পড়বেন।’ সন্ন্যাসী হুংকার দিয়ে ওঠেন, ‘খবরদার, নারী আমার মাতৃস্থানীয়া। আমি ব্রহ্মচারী। নারীর সঙ্গে কথোপকথন নিষিদ্ধ। তবে এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে শ্রীগোবিন্দ আমাকে কৃপা করলেন, এটাই আনন্দের। আমার আরও কিছু সেবাকার্য বাকি আছে। আপনারা গৃহে যান, সেবা শেষ করেই আমি এই স্থান ত্যাগ করব। শ্রীগোবিন্দ আপনাদের মঙ্গল করবেন।’
সাধু চলে যাবেন, এই সংবাদ পেেয় জমিদারের আত্মীয়স্বজনরা এসে অনেক কাকুতিমিনতি করেন। শুধু তিনদিন সেই স্থানে বাস করার জন্য অনুরোধ করলেন। অশ্বত্থ তলায় চন্দ্রাতপ টাঙানো হল। গ্রামের ব্রাহ্মণগণ গোবিন্দ সেবার জন্য ফল ফুল নিয়ে এলেন। সন্ধ্যায় শুরু হল নামসংকীর্তন। হরিকীর্তনে সকলকে মাতালেন সাধক লক্ষ্মীনারায়ণ। পরদিন সকালেও ভক্ত সমাগম হতে শুরু করল।
হঠাৎ এক ব্রাহ্মণ সাধুর কাছে এসে বললেন, ‘আপনি কি রাঢ় দেশীয় জগৎগুরু বংশীয় চট্টোপাধ্যায় কুলীন ব্রাহ্মণ?
– হ্যাঁ, আপনি জানলেন কী করে?
– আপনার সঙ্গে গোপনে কথা আছে।
সাধু অবাক হয়ে নিভৃতে গেলেন। ব্রাহ্মণ বললেন, ‘আচ্ছা, কামাখ্যা থেকে ফেরার সময় ব্রহ্মপুত্র নদীর তটে বসে আপনার উপাস্য গোবিন্দের মুখে কিছু শুনে ব্যাকুল হয়েছিলেন কি?’
–তারপর?
–তারপর পনেরো দিনের মধ্যে আপনার পিতার ঔর্ধ্বদৈহিক কাজ সম্পন্ন করে আমার কন্যাটিকে বিবাহ করতে হবে। দু’মাস হল আপনার পিতা পরলোকগমন করেছেন। শ্রীগোবিন্দ স্বপ্নে আমাকে এসব জানিয়েছেন। যা তিনি বলেছেন, আমি তাই নিবেদন করলাম।
সাধু একথা শুনে বজ্রাহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। তারপর চেতনা হলে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বললেন, ‘আমার কঠোর বক্ষ এবং শুষ্ক সেবাতে নিকুঞ্জবিহারী ব্রজরস-সুধাস্বাদী শ্রীগোবিন্দের প্রীতি হল না। আপনার কন্যার সেবা গ্রহণ করতে তাঁর ইচ্ছা হয়েছে। তাঁর যা ইচ্ছা, তাই হোক। তবে আমি আপনার কন্যার গর্ভে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েই সংসার ত্যাগ করব। আমি সমস্ত জীবন মায়ায় বদ্ধ হয়ে থাকতে পারব না।’
তারপর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘পিতার ইচ্ছাই ফলবতী হল। তবে তাঁর চরণ আর দর্শন করা হল না। মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শ্রীগোবিন্দ স্বয়ং আমায় জানিয়েছিলেন।’ এই বলে সাধু নীরব হলেন। সমাগত ব্রাহ্মণ গোবিন্দের জয়ধ্বনিতে মুখর করল সেই স্থান।
এই ব্রাহ্মণের নাম ছিল হরিপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর পনেরো বছর বয়সের কন্যা মধুমালতীর বা লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে লক্ষ্মীনারায়ণের বিবাহ হল। জীবনপ্রাপ্ত মুসলমান জমিদার শুধু বিবাহের খরচ বহন করলেন না, শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ যুগলের মন্দির প্রতিষ্ঠার সমস্ত খরচ বহন করেছিলেন। তার সঙ্গে বহু পরিমাপ জমি ও সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি রূপে দান করেছিলেন। এই পরিবারের গৃহদেবতা প্রতিষ্ঠিত হলেন মন্দিরে। ঠিক দুই বছর পর এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে তার ছয় মাস বয়সে আবার গৃহত্যাগ করলেন লক্ষ্মীনারায়ণ। এবার তাঁর দেবতা রইলেন গৃহে। তাঁর চরণে স্ত্রী-পুত্রের ভার দিয়ে, দেবতাকে হৃদয়ে ধারণ করে পথে বের হলেন। পুত্র জীবনকৃষ্ণ বড় হতে থাকলেন দাদু শ্রী হরিপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে।
জীবনকৃষ্ণের পুত্র কৃষ্ণমোহন। আর কৃষ্ণমোহনের পুত্র রসিকমোহন বিদ্যাভূষণ। যিনি শুধু ডাক্তার রূপে সুনাম অর্জন করেননি, তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতকে কলকাতা বা বঙ্গ সমাজে নববৈষ্ণব আন্দোলন সৃষ্টিকারী মহাত্মা শিশির ঘোষের সহায়ক। তিনি নিজে যে সমৃদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, শিশির ঘোষ তাঁর মূল্য বুঝেছিলেন।
আমাদের আলোচনার বিষয় দেবতা, মানুষের আন্দোলন নয়। প্রাচীন পরিবার রূপে তাঁরা নিশ্চয়ই কোনও দেব বিগ্রহের আরাধনা করতেন, সেই দেব বিগ্রহ কি একচক্রা বা সিউড়িতে অধিষ্ঠিত? আবার লক্ষ্মীনারায়ণ আরাধিত শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দের মূর্তি- যা ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সেই বিগ্রহ কি এখনও সেখানে আছে? এইসব প্রশ্ন নিয়ে অনুসন্ধানকালে আমরা দেখি, রসিকমোহনের জীবনীর মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর ছোট ভাই শ্রীযুক্ত মথুরামোহন ভক্তিরত্ন আটিয়ার অন্তর্গত বন্দাকাওয়ালখানি গ্রামে তাঁর প্রপিতামহ লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টরাজের হৃদয়ের ধন শ্রী রাধাগোবিন্দের নিষ্ঠাবান সেবক। তিনি এই মন্দিরে গৌরবিষ্ণুপ্রিয়ার যুগলবিগ্রহও প্রতিষ্ঠা করেন। দেবতা এখন সেখানে পূজিত।