সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী পাঠক্রমে রদবদল

সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী পাঠক্রমে রদবদল

শিক্ষা
Spread the love


সুমন্ত বাগচী

সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ‘ক্ষমতা’ প্রদর্শনের সবচেয়ে সহজ জায়গা যদি হয় অসহায় দরিদ্র রিকশাওয়ালা বা নিরীহ বধূ, তাহলে যে কোনও নতুন সরকারের ক্ষেত্রে তা অবশ্যই বিদ্যালয় স্তরের পাঠ্যসূচি। এই পাঠক্রমকে কত বেশি সরকারের পক্ষে ‘প্রচারক’ হিসাবে ব্যবহার করা যায়, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় মূল লক্ষ্য। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে বিদ্যালয়ের পাঠক্রম তৈরির জন্য বিভিন্ন ‘স্বয়ংশাসিত’ সংস্থা থাকলেও, বকলমে সরকারের ইচ্ছাই এইসব সংস্থার মাধ্যমে রূপায়িত হয়ে থাকে। প্রথম ধাপে এইসব সংস্থার নীতি-নির্ধারক পদ থেকে পুরোনো সরকারের ঘনিষ্ঠদের সরিয়ে নতুন সরকারের ‘আস্থাভাজনদের’ বসানো হয়। এরপর এই নতুন আস্থাভাজনরা সরকারের নির্দেশ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পালন করেন। হয়তো একটু সময় লাগে। কিন্তু সরাসরি সরকারকে দোষারোপ করা যায় না। বিভিন্ন শ্রেণির ইতিহাসের পাঠক্রম এই কাজে প্রথম পছন্দ। তারপর নজর পড়ে সাহিত্যের দিকে।

১৯৬১ সালে তৈরি এনসিইআরটি শিক্ষামন্ত্রকের অধীনে এমনই একটি ‘স্বয়ংশাসিত’ সংস্থা। এদের তৈরি পাঠক্রম সিবিএসই বোর্ডের স্কুলগুলি মেনে চলে। গোটা দেশে সিবিএসই বোর্ড পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিককালে এনসিইআরটি একটি ‘মডিউল’ প্রকাশ করেছে। এতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠক্রমে দেশভাগ সংক্রান্ত নতুন অধ্যায়ের সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। এই নতুন অধ্যায়ে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে– দেশভাগ কোনও একজনের কাজ ছিল না। তিনটি শক্তি সম্মিলিতভাবে এই কাজ করেছিল। শক্তি তিনটি হল- মুসলিম লিগের মহম্মদ আলি জিন্না, যিনি দেশভাগের কথা প্রচার করেছিলেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন- তাঁকে দেশভাগ সফলভাবে রূপায়িত করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কংগ্রেস- যারা দেশভাগ মেনে নিয়েছিল। প্রত্যাশিতভাবেই বিজেপি এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। বিজেপি নেতা শেহজাদ পুনাওয়ালার বক্তব্য, ‘আমরা তো তথ্য থেকে পালাতে পারব না। দেশভাগের সময় কারা নেতৃত্বে ছিলেন? মুসলিম লিগ আর জওহরলাল নেহরুর কংগ্রেস। দেশভাগের পক্ষে নেহরুর বক্তব্যও রয়েছে।’ আর স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেস তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তাদের দাবি, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগের আঁতাতের কারণে দেশভাগ হয়েছিল। আরএসএস দেশের পক্ষে বিপদ। ১৯৩৮ সালে হিন্দু মহাসভা প্রথমবার দেশভাগের ধারণার কথা প্রচার করেছিল। ১৯৪০ সালে জিন্না সেই কথার পুনরাবৃত্তি করছিলেন বলে তারা জানিয়েছে।

তবে এনসিইআরটি বহুদিন ধরেই স্কুল স্তরে ইতিহাসের পাঠক্রমে পরিবর্তন আনছে। সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে সুলতান যুগ এবং মোগল যুগের বেশিরভাগ অংশ তারা বাদ দিয়েছে। অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস বইয়ে এই দুই যুগকে ভারতীয় ইতিহাসের ‘অন্ধকার যুগ’ হিসাবে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকে ‘এশিয়ান মাইগ্রেশন থিওরিকে’ বাদ দেওয়া হয়েছে। আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসে ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’র কোনও উল্লেখ নেই। সাম্প্রতিক ভারতের ইতিহাসে ‘জরুরি অবস্থা’, ‘নকশাল আন্দোলন’–এর উল্লেখ নেই। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার নামগন্ধ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ডঃ আনন্দগোপাল ঘোষের মতে, দেশভাগ মূলত পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় চেয়েছিল। বর্তমান পাকিস্তান অঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায় সেভাবে দেশভাগ চায়নি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লিগ পূর্ববঙ্গে অনেক বেশি সিটে জয়লাভ করে। সেই তুলনায় বর্তমান পাকিস্তানে মুসলিম লিগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। পরবর্তীকালে বিরোধী নেতাদের হত্যার মাধ্যমে মুসলিম লিগ এই অঞ্চলে কর্তৃত্ব কায়েম করে। ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার তীব্র বিরোধী ছিলেন। তিনি এত বড় একটি দেশের আবির্ভাব রাজনৈতিক কারণেই চাননি। ভারতের স্বাধীনতার সময় ক্লিমেন্ট এটলি প্রধানমন্ত্রী থাকলেও তিনিও এই ক্ষেত্রে চার্চিলের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আনন্দবাবু মনে করেন, কংগ্রেসের আরও ধৈর্যশীল হওয়ার প্রয়োজন ছিল। স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য অহেতুক তাড়াহুড়ো দেশভাগকে সহজ করেছে। ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, কংগ্রেস বিভিন্ন মত, জাতি ও স্বার্থকে এক জায়গায় আনতে পারলেও মুসলিমদের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৪৪ সালে গান্ধি জিন্নার সঙ্গে আলোচনায় যেদিন শর্তসাপেক্ষে মুসলিমদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি মেনে নেন, সেই দিনই কংগ্রেস একটু একটু করে দেশভাগের দিকে এগিয়ে যায়। মালবাজার পরিমল মিত্র মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ডঃ শেষাদ্রি বসু এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েও মনে করেন, জিন্নাকে মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধি মনে করা কংগ্রেসের একটি বড় ভুল ছিল। তবে কংগ্রেসের সময়ও পাঠক্রম কিন্তু বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। দীর্ঘ কংগ্রেস আমলে বিদ্যালয় স্তরের ইতিহাস বইয়ে বিপ্লবীদের আরও গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল বলে ইতিহাসবিদদের অনেকের মত।

আমাদের রাজ্যেও পালাবদলের পরপরই বিদ্যালয় স্তরের পাঠ্যসূচি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সাল থেকে বিদ্যালয় স্তরে নতুন পাঠ্যসূচি চালু করা হয়। অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে একেবারে শেষে ‘সিঙ্গুর আন্দোলন’ নামে একটি অধ্যায়কে যুক্ত করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া সদ্য জেল থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর নাম আছে। কিন্তু সাতের দশকের সাড়া জাগানো নকশাল আন্দোলন স্থান পায়নি। আর বিভিন্ন শ্রেণির বাংলা বিষয়ের পাঠ্যসূচিতে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে।

আনন্দবাবু আক্ষেপ করে বলছিলেন, ইউরোপের কোনও দেশে এরকম হয় না। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের ইতিহাস বইয়ের ‘ইতিহাস’ বদলে ফেলা হয় না। সেখানে শক্তিশালী ‘সিভিল সোসাইটি’ আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার এত বছর পার করার পরেও শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারলাম না। শুধু তাই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণের শক্তিও বাড়ছে।

দেশভাগের মতো এত বড় ঘটনা যা তিনটি দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে সরাসরি আঘাত করেছিল, তার বহুমাত্রিক প্রভাব কতদূর ছড়ানো থাকতে পারে তাই নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, আগামীদিনেও হবে। কিন্তু ইতিহাসকে রাজনীতির নোংরা খেলায় ব্যবহারের এই রীতি স্বাধীন ভারতের নতুন প্রজন্মের যে সমূহ ক্ষতি করছে, এই নিয়ে কোনও সংশয় নেই। আজকের প্রজন্মের সঠিক কোনও ইতিহাস-বোধ তৈরি হচ্ছে না। তাই ভারতের মতো এত বড় এবং বৈচিত্র্যে ভরপুর দেশের ভবিষ্যৎ একেবারেই উজ্জ্বল নয়। এই ট্র্যাজেডি দেশভাগ-ট্র্যাজেডি থেকে কোনও অংশে ছোট নয়। এভাবে ‘ইতিহাস’কে আড়াল করলে তা ছোটদের সামনে দেশকে ভালোভাবে জানার সুযোগ করে দেবে না। আর এভাবে ‘আড়াল’ করার তো কোনও মানেও হয় না। সত্যিটা আসলে কী তা আজকাল জানার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যাই নেই। মাউসের এক ক্লিকেই তা মনিটরে হাজির বা আঙুলের ছোঁয়ায় মুঠোফোনের পর্দায়। বরং সত্যিটাকে আড়াল না করে ‘সত্য’কে জানার সুযোগ করে দেওয়াটাই মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ। তাতে যে কোনও সরকারের নিরপেক্ষতা সবার সামনে বজায় থাকে। আর এমন করা হলে সেই সরকারের বিষয়ে সবার শ্রদ্ধাটুকুও সমানভাবে বজায় থাকবে।

(লেখক পেশায় শিক্ষক।)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *