দীপ সাহা
যতবার সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করছি, ততবার উত্তর চব্বিশ পরগনার সেই তরুণীর মুখটা ভেসে উঠছে। কৃষ্ণমৃত্তিকা নাথ। স্নাতক স্তরে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ইউনিভার্সিটি টপার। গোল্ড মেডেল পেয়েছেন রাজ্যপালের কাছ থেকে। কিন্তু বিচারপতির কলমের এক খোঁচায় আজ তিনি রাস্তায়। মিশে গিয়েছেন অযোগ্যের ভিড়ে।
কৃষ্ণমৃত্তিকা একদিন স্বপ্ন দেখতেন, শিক্ষকতা করবেন। সমাজে শিক্ষার দ্যুতি ছড়াবেন। কিন্তু হায় রে নিয়তি! আজ তাঁর শিক্ষাটাই যে প্রশ্নের মুখে। কৃষ্ণমৃত্তিকা একা নন, তাঁর মতো হাজার হাজার তরুণ-তরুণী এখন দিশেহারা। চোখের সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেউ ঋণ নিয়ে বাড়ি-গাড়ি করেছেন, কেউ বা বিয়ের ভোজ খাওয়াতে হাত পেতেছিলেন অন্যের কাছে। রাতারাতি ‘বেকার’ হয়ে পড়ায় পাওনাদাররা এই তেড়ে এল বলে। কেউ দুশ্চিন্তায়, মায়ের ওষুধ কিনবেন কীভাবে, কেউ বা ডুকরে কাঁদছেন একরত্তির জন্য দুধের কৌটোটা আর কিনে আনতে পারবেন তো, শুধু এটা ভেবে।
এমনটা কি হওয়ার ছিল? ওঁরা প্রত্যেকেই তো ভেবেছিলেন, একটা সরকারি চাকরি লেগে গেলে জীবনটা আয়েশি হয়ে যাবে। মোটা অঙ্কের বেতন, অবসরের পর পেনশন। লাইফ পুরো সেট। ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের আর পাঁচটা সন্তান যেমন ভেবে থাকে। এতে ভুল কিছু নেই। কিন্তু আগামীতে আর কেউ কি স্বপ্ন দেখবেন সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করার? কিংবা নিদেনপক্ষে অন্য একটা সরকারি চাকরি জোটানোর? প্রশ্নটা কিন্তু দীর্ঘ হয় ক্রমশ।
সুপ্রিম রায় ঘোষণার পর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছিলেন, এ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঠিকই বলেছেন মাননীয়া। এ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ডকে ভেঙেচুরে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। আর সেটা ওঁর মদত ছাড়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।
বাংলায় বহুপ্রচলিত এই প্রবাদ বাক্যটি মুখ্যমন্ত্রীর জন্য যথার্থ। কারণ তাঁর দলের নেতারা চাকরি চুরি করেছেন জেনেও কোনও ব্যবস্থা নেননি। বোধহয় একটা ধমকও দেননি কাউকে। যদি সত্যিই দিতেন, তাহলে হয়তো এই দিনটা আর দেখতে হত না।
নিজেকে ‘বাংলার নিজের মেয়ে’ বলে পরিচয় দেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এই বাংলার হাজার হাজার যোগ্য শিক্ষকের চাকরি চলে যাওয়ায় তাঁর ভেতরে এতটুকুও অনুশোচনা দেখিনি। বরং অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে সাধু প্রমাণ করার তীব্র বাসনা চোখে পড়েছে। তাহলে কীসের বাংলার মেয়ে তিনি!
একটা কথা মাথায় রাখা দরকার, শুধু ভাতা আর বিনামূল্যে র্যাশন দিয়ে ভোট কেনা যেতে পারে, কিন্তু সম্মান নয়। উনি দলের নেতাদের থেকে একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন, সদ্য সুপ্রিম রায়ের পর কেউ যদি সবথেকে বেশি ধিক্কৃত হন, তা তিনিই। এটা কি লজ্জার নয়?
নাগরাকাটার হিন্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ২৫০০ মতো পড়ুয়ার জন্য সেখানে শিক্ষক ছিলেন সাকুল্যে ২৬ জন। তারমধ্যে একলপ্তে চাকরি হারিয়েছেন ১১ জন। স্কুলটি কীভাবে চলবে আগামীতে, জানেন না প্রধান শিক্ষক। কোনও দিশা নেই। গোটা রাজ্যে এমন উদাহরণ ভূরিভূরি। কোথাও হয়তো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক শূন্য, কোথাও আবার স্কুল চালানোর মতোই অবস্থা নেই।
প্রত্যেক অভিভাবক চান, তাঁর সন্তান ভালো স্কুলে লেখাপড়া করুক। মানুষের মতো মানুষ হোক। চাকরিবাকরি করুক। দিন আনা দিন খাওয়া, রাস্তায় বসে সবজি বেচা লোকটার তো সামর্থ্য নেই মোটা টাকা ডোনেশন দিয়ে ছেলেমেয়েকে বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর। তাই বাধ্য হন তাঁরা সরকারি স্কুলে ভর্তি করতে। কিন্তু বাংলা এখন যে শিক্ষা সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে, সেখানে ক’জন বাবা-মা চাইবেন তাঁর সন্তান সরকারি স্কুলে যাক! কিংবা গেলেও কতটুকু শিক্ষাই বা পাবে তারা? ভাবতে হবে। এবার সত্যিই ভাবতে হবে।
ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। কিন্তু এই বাংলায় শিক্ষা এখন মহার্ঘ। সরকারি শিক্ষা দিন-দিন বেহাল হতে থাকায় গত দশ বছরে ফুলেফেঁপে উঠছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। একশ্রেণির পুঁজিপতি শিক্ষাকে পণ্য করে তুলেছেন। আর সেই পণ্য ভোগ করতে শুরু হয়েছে হুড়োহুড়ি। বিত্তশালীরা হচ্ছেন সেই পণ্যের প্রথম ক্রেতা। মধ্যবিত্তও ছুটছে পিছুপিছু। পড়ে রয়েছে শুধু নিম্নবিত্তরা। এই ইঁদুর দৌড়ে সন্তানকে শামিল করতে না পারার যন্ত্রণা হয়তো কুরে-কুরে খাচ্ছে তাঁদের।
সেই দিনটা আর বেশি দূরে নেই, যখন বাংলায় ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাবে একের পর এক সরকারি স্কুলের। বাধ্য হয়ে এক অসহায় পিতা সন্তানের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘পড়াশোনা করে কী হবে! তার চেয়ে বরং টোটো চালা কিংবা মুটেগিরি কর। দু-পয়সা রোজগার তো করতে পারবি।’
অগত্যা এই বাংলা থেকে আরও আরও ট্রেন ছাড়বে কেরল, বেঙ্গালুরু কিংবা চেন্নাইয়ের উদ্দেশে। প্রতিটা কামরা থাকবে ভিড়ে ঠাসা। কিন্তু সেই ভিড়ে থাকবে না কোনও শিশু যে স্বপ্ন দেখে, ‘আমিও বড় হয়ে মাস্টারমশাই হতে চাই।’