শংকর
আমি কোনও চলচ্চিত্র বিশারদ নই। অজস্র ছবি দেখার অভিজ্ঞতাও নেই আমার। তবু মনে আছে সেই অভিজ্ঞতা। বহুবছর আগে দেখা সেই ছবির দৃশ্যগুলো আমাকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে, তার রেশ মৃত্যু পর্যন্ত কাটবে না। সত্যি বলতে, জীবনে এমন ঘটনা খুব কমই ঘটে থাকে।
যে ঘটনার কথা বলছি, তা সেই ১৯৫৫ সালের কথা। তখন বেঙ্গল চেম্বারের অফিসে কাজ করি। ভাদ্র মাসের ভরদুপুর। সেই ভ্যাপসা দুপুরেই আমরা অফিস পালিয়ে একটা ছবি দেখার ষড়যন্ত্র এঁটেছিলাম। কী ছবি, কোন ছবি দেখতে যাব? সে সবের তোয়াক্কা ছিল না। সেই সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছিল বাংলায় কঙ্কাবতীর ঘাট, হিন্দিতে নগদ নারায়ণ, ইংরেজিতে দেয়ার্স নো বিজনেস লাইক শো বিজনেস। এবং ওই একই সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছিল এক অখ্যাত পরিচালকের নতুন ছবি। বন্ধুর পাল্লায় পড়ে সেই অখ্যাত ছবিটাই দেখতে গিয়েছিলাম কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের বীণা সিনেমায়। তাই এই নবতিপর বয়সেও গর্ব করে বলতে পারি, কলকাতায় প্রথম দিনের প্রথম শো-তে পথের পাঁচালী দেখার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম আমি। এখন যাকে বলে এফডিএফএস।
অবশ্য এটাও ঠিক, পরিচালক হিসাবে নতুন হলেও সত্যজিৎ কিন্তু সংস্কৃতি জগতে নতুন নন। বিখ্যাত বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমার কলকাতা শাখার আর্ট ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছেন। কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার প্রচ্ছদশিল্পী হিসাবেও সত্যজিতের যথেষ্ট সুনাম অর্জন হয়েছে ততদিনে। ফলে, সিনেমা তৈরির খড়কুটো তিনি যে একটু একটু করে সংগ্রহ করেছিলেন, সেকথা বলাই বাহুল্য।
সবচেয়ে বড় কথা, দুর্ভাগা বাঙালির ঘরে জন্ম নিয়েও তিনি আমাদের বাঙালির, ভারতবাসীর মুখ উজ্জ্বল করেছেন জগৎসভায়। পথের পাঁচালী যে রসসৃষ্টির ইতিহাসে এক কীর্তিস্তম্ভ, তা সর্বজনবিদিত। পথের পাঁচালীর স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় এমন এক ঊর্ধ্বলোকে বিরাজ করেছেন, যেখানে কোনও প্রশস্তিই তাঁর পক্ষে সুবিচারের নয়। আর্টের ক্ষেত্রে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে এমন দুর্লভ ঘটনা ক্বচিৎ কদাচ ঘটে থাকে। বীণা সিনেমায় সিনেমা দেখতে বসে এই মহৎ সৃষ্টির প্রতি নতমস্তকে প্রণাম জানানো ছাড়া আমার মতো মানুষের আর কিছুই করার ছিল না।
পথের পাঁচালী দ্বিতীয় বার দেখি তিরিশ বছরের ব্যবধানে। কেন এত দীর্ঘ বিরতি? দেখিনি এই আশঙ্কায় যে, প্রথম দর্শনে বুকের মধ্যে যে বিস্ময়ের রসায়ন সৃষ্টি হয়েছিল তা নষ্ট হতে পারে, এমন কোনও ঝুঁকি আমি নিতে বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না। এবং এই অতি বৃদ্ধ বয়সেও স্বীকার করি, তিরিশ বছরের ব্যবধানে পথের পাঁচালী পুনর্দর্শনের দুঃসাহস দেখিয়ে আমি জীবনে ভুল করিনি। সেদিন মনে হয়েছিল, নতুন ছবি দেখছি। ছবিটা তো বদলায়নি, তাহলে কি আমি নিজেই বদলে গিয়েছি আপাদমস্তক! ঠিক বুঝতে পারিনি সেদিন। পথের পাঁচালীর দেশেই আমার জন্ম, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার গাঁয়ের লোক, দারিদ্র্য কাকে বলে তা আমিও বিলক্ষণ জানি। প্রথমবার পথের পাঁচালী দেখার সময় অপু-দুর্গা-সর্বজয়া-হরিহরের দুঃখ এতটা দুর্বিষহ মনে হয়েছিল যে, ছবিটা আর মাত্র মিনিট পনেরো চললে আমি ভেঙে খানখান হয়ে যাব বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এতগুলো দশক পরে মনে হয়, দুঃখের সঙ্গে চিরন্তন আনন্দের, মলিনতার সঙ্গে সীমাহীন সৌন্দর্যের এমন দুর্লভ মিলন যিনি এমন অনায়াসে করতে পারেন, রসসৃষ্টির ইতিহাসে তিনি চিরদিন তাজমহলের মতো বিরাজ করবেন এবং সর্বশ্রেণির শিল্পস্রষ্টার প্রণম্য হয়ে উঠবেন।
পথের পাঁচালী দেখার দীর্ঘ তিরিশ বছর পরে পুনরায় ছবিটি দেখা এবং পুনরায় বিস্ময়ে বিস্মিত হওয়া। তবে সেই বিস্ময়-রেশ কাটবার আগেই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল অগ্রহায়ণের এক নির্জন দুপুরে। ভেবেছিলাম, খোঁজ করব—সৃষ্টি বড় না স্রষ্টা বড়! স্রষ্টা নিজেই অনেক সময় তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন কিনা! কিন্তু আশ্চর্য এই, কলকাতার বিশপ লেফ্রয় রোডের তিনতলার সেই বিখ্যাত ঘরে সত্যজিতের মুখোমুখি হয়ে কোনও প্রশ্ন করার বাসনাই রইল না। যে মানুষ পথের পাঁচালী সৃষ্টি করতে পারেন সেই মানুষকে প্রশ্নোত্তরের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জেরা করার মতো উকিল তো নই আমি। সত্যজিৎ বোধহয় আমার সমস্যাটা বুঝেছিলেন। নিজের থেকেই বলেছিলেন, ‘তিরিশ বছর ধরে পথের পাঁচালী সম্পর্কে এত জায়গায় এত কথা বলেছি যে নতুন কথা কিছুই অবশিষ্ট নেই।’ বুঝতে পেরেছিলাম, উনি জানতে চাইছেন, আমি তিরিশ বছর ধরে কী করেছি! দেখা করতে এত দেরি হল কেন? নূতনত্ব সম্পর্কে আমার অহেতুক চিন্তা নেই। কারণ পথের পাঁচালী সংক্রান্ত কোনও কথাই কোনও দিন পুরোনো হবে না। চির নূতনের পরশপাথর যে অপু-দুর্গার ছবির মধ্যেই চিরদিনের মতো লুকিয়ে রয়েছে। সত্যজিৎ শুরু করলেন তাঁর কথা, ‘বিজ্ঞাপনের অফিসে আর্ট ডিরেক্টরের চাকরি করতাম, কোনও দিন যে চিত্র পরিচালক হব এমন ধারণা ছিল না। তবে ছবি দেখতে ভালো লাগত এবং পরে এই ভালোলাগাটাই সিরিয়াস টার্ন নিল। অনেকে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু মূল উপন্যাসটা পড়বার আগেই আমি পথের পাঁচালী ছবি তৈরির সিদ্ধান্ত নিই। ডি কে গুপ্তর প্রকাশনা সংস্থা সিগনেট প্রেসের জন্যে সংক্ষিপ্ত কিশোর সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’র ইলাস্ট্রেশন করছিলাম, সেই সময় আইডিয়াটা মাথায় এসে গিয়েছিল। সংক্ষিপ্তসারটাই আমাকে ভরসা দিল ছবিটা ম্যানেজেবল ফর্মে আনা যায়, মূল উপন্যাসটা প্রথমে পড়লে এই সাহস হয়তো আমার হত না।’
সত্যজিৎ বলে চলেন, ‘এই সময় বিজ্ঞাপন এজেন্সির কাজকর্ম সম্পর্কে আমার ক্লান্তি এবং বিতৃষ্ণা জাগছিল। প্রত্যেকটি ক্লায়েন্টকে খুশি করার কাজ ভালো লাগছিল না। তার ওপর অনেক খেটেখুটে হয়তো একটা ভালো কাজ করলাম, অবুঝ ক্লায়েন্ট এককথায় তা নাকচ করে দিলেন। মনের মধ্যে তখন স্বাধীন হবার ইচ্ছে, আমার এমন কোনও কাজ চাই যেখানে আমিই সর্বেসর্বা হব। সেই সময় আমি আপিসের কাজে সামান্য সময়ের জন্যে বিলেত যাই। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে ওখানে অন্তত একশোটা ছবি দেখে ফেলেছি। ইউরোপীয় গুরুদের ছবি দেখে মনে হয়েছিল নতুন ভাবে, নতুন পথে, অল্প খরচে, মানবিক আবেদনসম্পন্ন ছবি আমরাও বা তৈরি করতে পারব না কেন?’
‘তখনই নেশাটা চেপে গেল। ১৯৫০ সালের অক্টোবরে দেশে ফেরবার পথে জাহাজেই চিত্রনাট্যের একটা খসড়া তৈরি করে ফেললাম। তারপর কলকাতায় অফিস-কাজের ফাঁকে ফাঁকে চিত্রনাট্যের কাজ করেছি। এবার ভাবলাম কোনও প্রোডিউসারকে আগ্রহী করা যায় কি না। ধর্মতলায় প্রোডিউসারদের দরজায়-দরজায় ঘুরেছি, কত লোককে বারবার শুনিয়েছি, জুতোর গোড়ালি খয়ে গিয়েছে, কিন্তু কাউকে রাজি করাতে পারিনি। তখন রাগ হত, এখন দোষ দিই না ওঁদের। আমাদের কারও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। প্রোডিউসারদের নিশ্চয় সন্দেহ হত, এঁরা কি পারবেন? কিন্তু ছবি করার ইচ্ছেটা তখন এতই প্রবল যে আমার অফিসের ইংরেজ ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলি, একটা ছবি করে দেখতে চাই। ম্যানেজার বললেন, উইকএন্ডে কাজ করো, ছুটিছাটায় কাজ করো। আমি এক মাসের সবেতন ছুটি পেলাম। প্রোডিউসারের দ্বারস্থ না হয়ে, আমাদের নিজেদের যে সংগতি আছে, তাই দিয়েই কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত হল। ইতিমধ্যেই অপু এবং দুর্গাকে পাওয়া গিয়েছে। আমরা ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে জগদ্ধাত্রীপুজোর দিনে এক কাশবনে শুটিং আরম্ভ করলাম। লোকেশন শক্তিগড়ের আগে পালসিট স্টেশনের কাছে। প্রকাণ্ড মাঠে কাশবন, সেখান থেকে অপু-দুর্গা ট্রেন দেখবে।’
সত্যজিৎ প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাও ভাগ করে নিলেন। ‘প্রথম দিনেই আমাদের অনেক ভুল ভাঙল। আমরা অনেক থিওরি আয়ত্ত করেছি, অথচ হাতেনাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই আমাদের। কিন্তু আমরা দমে যাইনি, কাজ করতে করতে আমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি এবং এগিয়ে গিয়েছি। আমার মনে আছে, আবার যখন শক্তিগড়ে গিয়েছি, তখন কাশফুল শুকিয়ে গিয়ে মাঠের রূপ অন্য হয়ে গিয়েছে। আমরা আবার এক বছর পরে সেখানে ফিরে এসেছি কাশবনের খোঁজে।’
চরিত্রদের কথাও সত্যজিৎ বলে চললেন নাগাড়ে। বিশেষ করে ইন্দির ঠাকরুণের কথা। সত্যজিৎ তাঁর একটি লেখার উল্লেখ করলেন। অপু, দুর্গা, হরিহর, সর্বজয়ার ভূমিকা নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। প্রসন্ন, সেজোঠাকরুণ, নীলমণির স্ত্রীর সম্বন্ধেও মনস্থির হয়ে গিয়েছে। চুনিবালা দেবীর হদিস দেন রেবাদেবী। চুনিবালা দেবী নাকি নিভাননী দেবীর মা, একসময় তারাসুন্দরী, নগেন্দ্রবালার মঞ্চে অভিনয় করেছেন। তো যাই হোক, চুনিবালা দেবী আমাদের হতাশ করলেন না। ‘পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা, গাল তোবড়াইয়া গিয়েছে, মাজা ঈষৎ ভাঙিয়া শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে।’ বর্ণনার সঙ্গে অমিল হল না।
চুনীবালা দেবীকে নিয়ে কাজ করার সময় বারবার এই কথাটাই মনে হয়েছে যে, এঁর সন্ধান না পেলে আমাদের পথের পাঁচালী সার্থক হত না।’
সত্যজিৎ এও বলেছিলেন, ‘যে আড়াই বছর ধরে পথের পাঁচালী তৈরি করেছি সেই সময়ে আমার অফিসে তিনজন ম্যানেজার এসেছেন—এঁরা তিনজনই আমাকে যথেষ্ট সহানুভূতি দেখিয়েছেন। কখনও পুরো ছুটি, কখনও হাফ পে, কখনও উইদাউট পে ছুটি দিয়েছেন। শেষ ম্যানেজার নিকলসন ছবিটা যখন প্রায় শেষ করে এনেছি, তখনই দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এটাও বোধহয় বুঝেছিলেন, একে বোধহয় আর অফিসে ধরে রাখা যাবে না।’
সত্যিই ধরে রাখা যায়নি আমাদের সত্যজিৎকে। কোনও নিক্তিতেই তাঁকে ধরা যায় না, মাপা যায় না। তিনি যে বিশ্ববন্দিত, বিশ্বনন্দিত। এমন উচ্চশিরের বাঙালি বিরলতম।