দাসত্ব স্বীকার করে কেন থাকব বাগানে?

দাসত্ব স্বীকার করে কেন থাকব বাগানে?

ব্লগ/BLOG
Spread the love


শুভঙ্কর চক্রবর্তী, দার্জিলিং: জরাজীর্ণ ইটের গাঁথুনিতে কোথাও প্লাস্টারের চিহ্নমাত্র নেই। শ্যাওলার পুরু আস্তরণ পরিষ্কারের পরও টিনের ফুটো বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল দেওয়ালজুড়ে নীল-সবুজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বারান্দার বাঁশের খুঁটিগুলো যে কোনও সময় ভেঙে পড়তে পারে। সেখানেই প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরা রান্নাঘরে মাটির উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তিনটি স্টিলের থালা ও দুটি বাটি। ওভেনযুক্ত ছোট্ট সিলিন্ডারের গা জুড়ে তরকারির চিহ্ন। তার সামনেই একটা চটের বস্তা পেতে বসলেন সুন্দরী গুরুং। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই চরম দারিদ্র্যে মেয়েকে বড় করে তোলার লড়াইয়ের কথা শোনাচ্ছিলেন।

বস্তায় বসেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দশাই কো বেলা নানী লাই নয়া লুগা কিন দিনু কো লাগি ভনেকো থিও। সকিনা। উলাই ঘর মা রোকেরো রাখনে কো অধিকার পানি ছয়না।’ (পুজোর সময় মেয়েটা একটা নতুন জামা চেয়েছিল। দিতে পারিনি। ওকে বাড়িতে আটকে রাখার কোনও অধিকার আমাদের নেই) বন্ধ পানিঘাটা চা বাগানের পরিত্যক্ত একটি কোয়ার্টারেই এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই সুন্দরী ও তাঁর স্বামীর। অসুস্থ স্বামী কর্মক্ষমতা প্রায় হারিয়েছেন। বছর পঁচিশের একমাত্র মেয়ে বছর খানেক আগে এক এজেন্টের সঙ্গে দিল্লি গিয়েছেন। কাজ পেয়েছে কি না তা জানেন না সুন্দরী। কী করছেন, কোথায় আছেন তারও খোঁজ নেই। তবে মেয়ে মাঝেমধ্যে ফোন করে সেটাই ভরসা।

সুন্দরী ও তাঁর স্বামী দুজনেই চা শ্রমিক ছিলেন। বাগান বন্ধ হওয়ায় কিছুদিন পাথর ভাঙার কাজ করেছিলেন। এখন কাজ জুটলে কোনওদিন অন্য বাগানে যান সুন্দরী, না জুটলে জঙ্গলে যান কাঠ কুড়োতে। মা হিসাবে মেয়েকে একটা জামা কিনে দিতে না পারার ব্যর্থতা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে কুরে-কুরে খাচ্ছে সুন্দরীকে। লজ্জা লুকোতে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর চোখের জল মুছে অতিথি আপ্যায়নে চা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

আকাশে তখন মেঘ আরও গাঢ় হতে শুরু করেছিল। খানিক বাদে আঝোরে বৃষ্টি নামল। যেন সুন্দরীর কান্না। পাহাড়ের চা বাগান থেকে তরুণ, তরুণীরা কেন ভিনরাজ্যে বা শহরে চলে যাচ্ছে, কেন ফাঁকা হচ্ছে বাগান সুন্দরীর চোখের দু’ফোঁটা জলেই লুকিয়ে ছিল তাঁর উত্তর।

ফুগুরি চা বাগান পেরোতেই গোটা মিরিকের আকাশ ঢেকে গেল ঘন কুয়াশায়। সামনে থেকে আসা গাড়ির আলোও চোখে পড়ছিল না। শোনা যাচ্ছিল শুধুও ক্ষীণ হয়ে আসা হর্ন। ঠিক যেন ‘দার্জিলিং চা’- এর বাগানগুলির নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। কোথাও আলোর দিশা নেই।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম কেটে গেলেও চা শ্রমিকদের জীবনে অন্ধকার যে কাটেনি, অনেক আগেই তাঁর গবেষণাপত্রে সেই প্রমাণ দিয়েছেন ইফতিকার উল আওয়াল। উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের প্রথমে বাংলার চা শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে নানা তথ্য উঠে এসেছে সেই গবেষণায়। দেখা যাচ্ছে, ১৯০০ সালে দার্জিলিংয়ের চা শ্রমিকদের গড় মাসিক মজুরি ছিল, ছেলেদের ক্ষেত্রে ৫ টাকা ৮ আনা আর মেয়েদের ৪ টাকা ৮ আনা। বর্তমানে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ২৫০ টাকা। ১২৫ বছরে চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির পরিসংখ্যানই অনেক না বলা কথা বলে দেয়।

পাহাড়ের ৮৭টি চা বাগানে কাজ করা প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক, যারা বছরে প্রায় ৯৬ লক্ষ কিলোগ্রাম জিআই-ট্যাগযুক্ত ‘দার্জিলিং চা’ উৎপাদন করে তাদের সামান্য মজুরি এই প্রজন্মের সন্তানদের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে যে ব্যর্থ সরকারি মূল্যায়নেই তা বারে বারে উঠে এসেছে। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনির মজুরিতে দুই বেলা পুষ্টিকর খাবার জোটানোই যেখানে দুষ্কর সেখানে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার গল্প বাস্তবায়িত করা যে অলীক কল্পনামাত্র তা মানছেন অনেক বাগান মালিকও। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অর্থের সংস্থানেই তাই বাগান ছাড়ছে তরুণ প্রজন্ম।

এর ফলে বাগানে বাগানে দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট। টিংলিং বাগানেও ধীরে ধীরে কমছে শ্রমিক। পাতা তোলা থেকে বাগানের অন্য কাজে তাই কর্তৃপক্ষ শ্রমিক আনছে নকশালবাড়ি, পানিঘাটা, শিলিগুড়ি থেকে। বাগানের শ্রমিক মহল্লায় দাঁড়িয়ে দুর্দশার সাতকাহন শোনাচ্ছিলেন স্মৃতি দেওয়ান। জানালেন, তিন পুরুষ ধরে তাঁরা চা বাগানে কাজ করছেন। কিন্তু নাতিকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পারেননি। তারপর নাতি রোজগার শুরু করতে বাড়ি ছাড়ে। প্রথমে শিলিগুড়িতে কিছুদিন একটা দোকানে কাজ করত। এখন কলকাতায় একটা রেস্তোরাঁয় রান্নায় সহযোগী হিসাবে কাজ করছে। নিজের টাকায় বাইকও কিনেছে। স্মৃতির কথা, ‘বাগান ছেড়ে ভালোই করেছে। এখানে থাকলে হয়, না খেয়ে মরত না হয় অপকর্মে জড়িয়ে যেত।’

দার্জিলিং শহরের কাছেই হ্যাপিভ্যালি চা বাগান। বাগানের তরুণ মহেশ গুরুং দিল্লিতে একটি শপিং মলে কাজ করেন। ফাঁকা সময়ে খাবার ডেলিভারি দিয়ে বাড়তি আয় করেন। সব মিলিয়ে মাসে গড়ে ৪০ হাজার টাকা আয় তাঁর। টাকা জমিয়ে বাড়িতে হোমস্টে তৈরির পরিকল্পনা করছেন। বাগানের কাছেই মোমো খেতে খেতে ক্ষোভের সঙ্গেই মহেশ বলে চলেন তঁার ক্ষোভের কথা, তোলেন প্রশ্ন, ‘বংশপরম্পরায় আমরা যে জমিতে বসবাস করে আসছি তার উপর আমাদের কোনও অধিকার নেই। আমাদের তৈরি করা বাড়িতে থাকতে হলে, আমাদের পরিবারের অন্তত একজন সদস্যকে বাগানে কাজ করতে পাঠাতে হবে। অন্যথায়, আমরা বংশপরম্পরায় তাদের মালিকানাধীন বাড়িতে বসবাসের অধিকার হারাব। এত সবের পরেও বাগানে আমাদের আইনি অধিকার কার্যত কিছুই নেই। এই ভয়াবহ দাসত্ব স্বীকার করে কেন থাকব বাগানে?’ এই প্রশ্নের উত্তর মিললেই হয়তো পাহাড়ের বাগানে ফিরবেন তরুণ, তরুণীরা। আদৌ কি কোনওদিন মিলবে উত্তর?



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *