- কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য
হ্যাঁ, যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, শিকারিমন পালটে না যায়, তাহলে ভারতের লোকসভার নির্বাচনে অনেকের সঙ্গে এবার থেকে ভোট দেবে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অরণ্যবাসী কয়েকজন ‘জারোয়া’ও। মাত্র শ’চারেক জনসংখ্যাবিশিষ্ট বিশ্বের অন্যতম আদিম শিকারিমানবদের অন্তত ১৯ জনকে ভোটের পরিচয়পত্র দিতে পেরেছে ভারত সরকার। এখন ভোটের লাইনে তাদের এনে দাঁড় করাতে পারলে জারোয়াদের অন্তত একটি ছোট অংশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস দৃঢ় হবে, এরকমই ভাবছে মোদি সরকার। গত ৭ জানুয়ারি জারোয়া জনজাতির মানুষের হাতে ভোটার পরিচয়পত্র তুলে দিয়ে কেন্দ্রশাসিত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মুখ্যসচিব, চন্দ্রভূষণ কুমার বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালানোর পর মর্যাদার সঙ্গে জারোয়াদের গণতন্ত্রের অংশ করতে পারাটা একটা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।’ ফলে, ভারতীয় গণতন্ত্রে নেগ্রিটো রক্ত আসছে বলতেই হবে!
জারোয়া সম্পর্কে এই লেখকের যতটুকু জ্ঞানগম্যি, তাতে মনে হচ্ছে, কাদের ভোটার করা হচ্ছে? কেন? জারোয়াদের কী দেবে সরকার? ওদের বিদ্যুৎ লাগে না, পাকা রাস্তা লাগে না, পানীয় জল লাগে না, ডাক্তার লাগে না, স্কুল, পাকা বাড়ি, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, টাকাপয়সা ছাড়াই তো এই আন্দামান দ্বীপের জঙ্গলে ওরা বেঁচে আছে ৬০ হাজার বছর! ৭ হাজার মাইল দূরের আফ্রিকা থেকে ভারত মহাসাগর পেরিয়ে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে নেগ্রিটো মানববংশী জারোয়াদের পূর্বপুরুষরা যখন আন্দামানে আসে তখন থেকেই তো ওরা বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কহীন! সেই আদি অরণ্যের পশুশিকার, সমুদ্রের মাছ আর নিতান্ত দেশীয় ঔষধির ওপর ভরসা করে জারোয়ারা তাদের মতো করে বেঁচে আছে! ভারতের শুধু নয়, গোটা বিশ্বেই তারা হোমোসেপিয়ান আদিমানবদের অন্যতম! এখনও পর্যন্ত ওদের গায়ে সেই প্রাগৈতিহাসিক রহস্যময় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, প্রশস্ত থেকে গোলাকার মাথায় রুক্ষ-পশমি চুল আর সেই আদি খর্বকায় দেহ! ভোট তাদের নতুন কী দেবে?
ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, আন্দামান ও নিকোবরের যথাক্রমে ৬,৪০৮ ও ১,৮৪১ বর্গকিলোমিটার এলাকার চিরহরিৎ, পর্ণমোচী ও লবণাম্বু বা ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গহনে, প্রায় দেড়শো রকম গাছগাছড়া ও সাড়ে তিনশো প্রজাতির বন্যপ্রাণ ও বহুবর্ষজীবী মিঠাজলের নদীনালা নিয়ে ভারতের পাঁচটি বিশিষ্ট আদিম মানবগোষ্ঠী, শিকারি ও যাযাবর-সংগ্রাহকের জনজাতীয় জীবনযাপন করে। এদের মধ্যে অত্যন্ত সংবেদনশীল জারোয়ারা থাকে দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামানের প্রায় ১ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ঘন জঙ্গল, জারোয়া রিজার্ভে। স্বাধীন ভারতে, ‘আন্দামান ও নিকোবর আইল্যান্ডস (প্রোটেকশন অফ অ্যাবোরিজিনাল ট্রাইবস) রেগুলেশন, ১৯৫৬’ আইনের সংরক্ষণে তারা ভারতের বিশেষ মানবগোষ্ঠী। তথাকথিত সুসভ্য দুনিয়ার মানুষ কেন, পাশের নিকোবর দ্বীপের শ’দুয়েক ‘সোম্পেন’, নর্থ সেন্টিনাল দ্বীপবাসী শ’খানেক জনসংখ্যার ‘সেন্টিনালিজ’, লিটল আন্দামানের শ’খানেক ‘ওঙ্গে’ এবং দক্ষিণ আন্দামানের দুর্গম ছোট্ট একটি দ্বীপের জনা তিরিশেক ‘গ্রেট আন্দামানিজ’-দের সঙ্গেও এদের কোনও যোগাযোগ নেই। এরা নিজেদের গোষ্ঠী ছাড়া কেউ কাউকে চেনে না, জানে না। এখন একটু নরম হলেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত ওরা অ-জারোয়া দেখলেই বিষতির মেরে সেই বিজাতীয়কে মেরে ফেলত। নিজেদের জঙ্গল ছাড়া এরা কেউ বাইরে আসে না, অন্য কাউকেই এরা নিজেদের এলাকায় ঢুকতেও দেয় না। এই পাঁচটি আদিম জাতি হাজার হাজার বছর ধরে নিজেদের তৈরি করা, বহির্বিশ্বের অজানা, এক নিজস্ব সার্বভৌমত্বের শক্তিতে চলে। ফলে ভোটের অধিকারের চাইতেও জারোয়াদের জরুরি ছিল তাদের জল-জঙ্গলের নিশ্চিত অধিকার। অ্যাডভেঞ্চারিস্ট পর্যটকদের হাত থেকে ওদের মুক্ত থাকার অধিকার। জারোয়া রিজার্ভের বুক চিরে যাওয়া বহুবিতর্কিত পোর্ট ব্লেয়ার (এখন বিজয়পুরম) টু দিগলিপুর, ৪ নম্বর জাতীয় মহাসড়ক, আন্দামান ট্রাংক রোড ধরে পর্যটক সাফারির ওপর জারোয়াদের স্বার্থে জারি করা সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি মেনে নিলেও জারোয়ারা নিজেদের সেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারত। মূলস্রোতে টানার অতি সক্রিয় সরকারি কর্মসূচির জেরে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন জারোয়ারা। না ঘরকা না ঘাটকা! ইংরেজিতে সম্ভবত একেই বলে, ‘প্রেডিকামেন্ট’!
অনেকেই হয়তো জানেন, জারোয়াদের মূলস্রোতে আনার জন্য যা করা হচ্ছে সেটা বৃটিশ জমানা থেকেই চলছে। কাজের কাজ তো কিছু হয়ইনি, উলটো এসব করতে গিয়ে আন্দামানের ‘সেন্টিনালিজ’ নামে একটি আদিম মানবগোষ্ঠীর জনসংখ্যা, ৫ হাজার থেকে কমে এখন ৫০-এ এসে ঠেকেছে (মতান্তরে ২৭)। এরা বিলুপ্তপ্রায়! দক্ষিণ আন্দামানের দ্বীপবাসী ‘গ্রেট আন্দামানিজ’ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ‘বো’ মানবগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
এখানে প্রাসঙ্গিক যে ১৮৫৮ নাগাদ আন্দামানে ব্রিটিশদের ‘দ্বিতীয় পেনাল কলোনি’ স্থাপনের সময় পর্যন্তও অন্যান্য কিছু শিকারিগোষ্ঠীদের কাউকে কাউকে বহির্জগতের সংস্পর্শে আনা গেলেও, জারোয়ারা তাদের আত্মরক্ষামূলক নীতি নিয়ে বিচ্ছিন্নই থাকছিল। ১৯৯৭-এ ‘এনমেই’ নামে এক জারোয়া তরুণের পা ভাঙে। ঘটনাচক্রে তাকে আন্দামান প্রশাসন পোর্ট ব্লেয়ারের জেবি পন্থ হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলে। সেই থেকে জারোয়াদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের সংযোগ স্থাপিত হতে শুরু করে। সেই সম্পর্ক এখন ভোটে এসে ঠেকেছে। কিন্তু জারোয়াদের জীবন তো এখনও সেই আদিম শিকারি ও সংগ্রাহকের জীবন। পৃথিবীর যে কোনও বাজার, যে কোনও মুদ্রা, যে কোনও অ-জারোয়া সংস্কৃতিই তাদের কাছে অর্থহীন! এই জীবনে ভোট? কাকে ভোট দেবে প্রকৃতিপন্থী জারোয়ারা? কেন দেবে? জারোয়া ভোট ভারতীয় গণতন্ত্রকে কোন নতুন দিশা দেবে?
আগেই বলেছি, জারোয়ারা তাদের জঙ্গলের শ’দেড়েক গাছগাছড়া ও সাড়ে তিনশো রকমের বন্যপ্রাণের ওপর এখনও নির্ভরশীল। জঙ্গলের ভেতরে ওরা অস্থায়ী ‘চাড্ডা’ (শিকার শিবির) বানিয়ে থাকে। শিকারের সম্ভাবনা অনুযায়ী ওরা এই চাড্ডাগুলো সরিয়ে নেয়। ওরা ভাত-রুটি চেনে না। জারোয়াদের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও ডিনার হয়, বুনো শুয়োর, দৈত্যাকার টিকটিকি, সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া, শামুকজাতীয় প্রাণী বা কচ্ছপের মাংস ও ডিম দিয়ে। ডিনারে জারোয়াদের পছন্দ, নানা ধরনের কন্দ, অঙ্কুর বা ফল। যা কিছু শিকারলভ্য, সেগুলো জারোয়া পুরুষরা তাদের আও (তির) ও পাথো (ধনুক) দিয়ে শিকার করে নেয়। নারীরা মাছ, ফল, মধু সংগ্রহ করে। আন্দামানে মাত্র গোটা পঞ্চাশেক জারোয়া-চাড্ডার অস্তিত্বের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। একেকটা চাড্ডায় রক্ত সম্পর্ক ও বিবাহসূত্রে আবদ্ধ জনা সাত/আটেক লোকের একেকটি দল! ওরা বলে ‘ব্যান্ড’ (পরিবার)। নিজেদের মতো করে ওরা মরশুম তৈরি করে নিয়েছে, পাঁচভাগে ভাগ করেছে তাদের নিজস্ব মহাকাশ। এই তো জারোয়া সমাজ! তা ওরা শিকার করবে না ভোট দেবে? তাছাড়া আন্দামানের প্রায় ২ লক্ষাধিক সাধারণ ভোটারের মধ্যে এই ১৯টি জারোয়া ভোট তো সিন্ধুতে বিন্দুর মতোই!
প্রকৃতিকে জয় করে বেঁচে থাকার কৌশল জারোয়ারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে। মৌচাকের হিংস্র মৌমাছিদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য হাজার বছরের প্রাচীন জারোয়া কৌশল বিখ্যাত। মধু সংগ্রহের সময় জারোয়া বালক-বালিকারা ঝোঁপ থেকে তানগোপামথ, হুমান ও উইয়াও গাছের পাতার রস গায়ে ও মাথায় মাখিয়ে নেয়। এই রসে মৌমাছি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আন্দামান প্রশাসনের দেওয়া লোহা ও ধাতুপাত্র দিয়ে ওরা এখন তির, ধনুক, মাছ ধরার জাল, খনন করার বড় ছুরি, দাও বানায়। সেসব দিয়ে কাঠের বালতি, বেতের ঝুড়ি বানায়। জারোয়া মহিলারা গাছের পাতা, ফুল ও শিকড় দিয়ে অঙ্গসজ্জার জন্য মালা, কোমরবিছা, মাথার ফিতে বানায়। লাল ও সাদা মাটি বা শুয়োরের চর্বি দিয়ে অঙ্গসজ্জা জারোয়া মেয়েদের বড় প্রিয়। জারোয়াদের আদিম পরম্পরাগত রীতিরেওয়াজ কোনও আধুনিকতার ধার ধারে না। সমাধিস্থ করার কয়েকমাস পর এরা নিকটাত্মীয়ের কবর থেকে নির্দ্বিধায় কঙ্কালের হাড়, চোয়াল ইত্যাদি খুঁড়ে বের করে নেয়। এগুলো একটু পরিষ্কার করে জারোয়ারা কোমরে বা ঘাড়ে পরে। জারোয়ারা তাদের ভাষা কাউকে দেয় না, কারও ভাষা নেয় না!
জারোয়াদের সঠিক সেন্সাস করা যায় না, কারণ এরা আদি শিকারিদের মতো জঙ্গলের একেক জায়গায় ‘চাড্ডা’ (অস্থায়ী শিকার শিবির) বানিয়ে থাকে। এক জায়গায় শিকারপর্ব চুকিয়ে এরা দলবদ্ধভাবে খুব তাড়াতাড়িই জঙ্গলের অন্য প্রান্তে তাদের চাড্ডা শিফট করে।
জারোয়াদের গোপন সার্বভৌম সংসারের সকল গোপন ও আদি জনজাতীয় বাঁচার কৌশল ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে প্রবল পরাক্রমশালী আন্দামান ট্রাংক রোড। সেই সড়কের সাফারির পর্যটকরা উলঙ্গ জারোয়াদের দেখতে চায়, পারলে এই আদিমানবদের সঙ্গে ছবি তুলতে চায়! তারা জারোয়াদের মদ দেয়, সিগারেট দেয়! এর সঙ্গে নতুন যুক্ত হল, ভোটের রাষ্ট্রীয় পলিটিক্স!
(লেখক লোকগবেষক ও সাহিত্যিক। শিলিগুড়ির বাসিন্দা)