আম চুরির অপরাধে মৃত্যুদণ্ড! অমানবিক কাণ্ড ঘটেছে নৈহাটির আতিসারা গ্রামে। এত নিষ্ঠুর হয় মানব-হৃদয়! জনতার রোষে পুড়ল বাগান।
আমবাগানের গাছে ঝুলছে পাকা আম। শুনশান দুপুরবেলা। দু’-একটা আম পেড়ে খেতে ইচ্ছা করবে না, এমন বাঙালি বিরল। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এমন ভরপুর আমবাগানের আহ্বানে পড়েই হয়তো ‘বর্ণপরিচয়’-এ ‘আ’ বর্ণের পরিচিতিতে লিখেছিলেন– ‘আমটি আমি খাবো পেড়ে’। ‘আ-এ আম’ ছাড়া তাঁর আর কিছু মনে পড়ল না। চোখের সামনে একটি পাকা আমের নধর শরীর ফুটে উঠতেই, লিখলেন আম পেড়ে খাওয়ার কথা, আমগাছ যারই হোক না কেন। তিনি কিন্তু লিখতেই পারতেন, আমটি আমি খাবো কিনে।
কিন্তু কিনে আম খাওয়া, আর গাছ থেকে পেড়ে আম খাওয়ার আল্লাদ যে এক নয়, কোন বাঙালি না জানে! তবে বিদ্যাসাগর ছিলেন দূরদ্রষ্টা। আম দেখলেই পেড়ে খাওয়ার মধ্যে পিছন থেকে বিপদ তেড়ে আসার ঝুঁকি আছেই আছে। সুতরাং বিদ্যাসাগর লিখতে দ্বিধা করেননি– ‘অ’-এ অজগর আসছে তেড়ে। কী নির্ভুল সংকেতে বাস্তবতার পাঠ তিনি দিয়ে গিয়েছেন! কিন্তু সম্প্রতি নৈহাটির শিবদাসপুর থানা এলাকার আতিসারা গ্রামের এক আমবাগানে যে নিষ্ঠুর, অমানবিক ঘটনা ঘটে গেল, কল্পনার অতীত।
এই গ্রামে ১৪-১৫ বছরের সুদীপ্ত এসেছিল তার মামার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পরে সে তার দুই বন্ধুকে নিয়ে গ্রামের মধ্যে একটু ঘুরতে বেড়িয়েছিল। কাছেই চোখে পড়ল এক আমবাগান। অসংখ্য আম ঝুলে আছে গাছ থেকে। আম পেড়ে খাওয়ার লোভ এবং আনন্দ সামলাতে পারেনি সুদীপ্ত। ঢিল ছুড়ে যেই না নামিয়েছে দুটো আম, অমনি তেড়ে এল আমবাগানের ‘অজগর’ চৌকিদার শেখ ফারহাদ, ওরফে ফুরাদ মণ্ডল। দুই বন্ধু দুরন্ত ছুট দিয়ে পালাল। কিন্তু সুদীপ্ত পড়ে গেল ধরা। যখের ধনের মতো বাবুদের সেই আম্র রত্নভাণ্ডার গার্ড দেয় ফারহাদ খান। তার হাতে ধরা পড়েছে দু’টি আম চুরির ভয়ংকর অপরাধী কিশোর সুদীপ্ত। ফারহাদ তাকে মৃত্যুদণ্ড দিল।
পিটিয়ে মেরে ফেলল সুদীপ্তকে। তারপর সেই নিথর দেহ ফেলে বাড়ি চলে গেল। অচিরে আবিষ্কৃত হল সুদীপ্তর দেহ। এবং দুটো আম। কেউ দাঁত বসায়নি। এবং ফারহাদ গ্রেপ্তার হল তার বাড়ি থেকে। তারপর শুরু হল বিরোধী দলগুলির আম চুরির অপরাধে কিশোর-হত্যার রাজনীতি। প্রথমেই আগুন লাগানো হল আমের গোডাউনে, যেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি আম পুড়ল। এরপর জনতা গেল আরও খেপে। আগুন লাগিয়ে দিল সারা আমবাগানে। এরপর বিরোধী দল বেরল স্লোগান দিয়ে।
এই আকস্মিক আম্র-রাজনীতি ও জাগরণের মধ্যে কারও কারও মনে পড়ে যেতে পারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনন্য উপন্যাস, ‘আম আঁটির ভেঁপু’। বাঙালির মনকেমনে ভেসে আসতে পারে ফেলে আসা গ্রামের আমবাগানের গন্ধ, পাতার শব্দ, ঢিল মেরে গোটাকতক আম নামানোর উৎকণ্ঠা ও উল্লাস!