প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমানঃ কারও কাছে তিনি পরিচিত ‘ঝাঁকলাই’ নামে, আবার কেউ তাকে বলেন ‘ঝঙ্কেশ্বরী’। এমন নানান নামে যার পরিচিতি তিনি আসলে হলেন কেউটে প্রজাতির ‘বিষধর সাপ’। বংশ পরম্পরায় প্রতি বছর আষাঢ়ের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে তাঁকেই দেবীজ্ঞানে পুজো করে আসছেন পূর্ব বর্ধমানের ভাতার ও মঙ্গলকোটের সাতটি গ্রামের বাসিন্দারা।
মহা ধুমধাম করে শুক্রবার ’ঝাঁকলাইয়ের’ পুজো হল ভাতারের বড়পোশলা, শিকোত্তর, মুকুন্দপুর এবং মঙ্গলকোটের ছোট পোশলা, পলসোনা, মুশারু এবং নিগন গ্রামে। পূর্বে এই সাত গ্রামে ঝাঁকলাইয়ের অবাধ বিচরণ থাকলেও বর্তমানে ভাতারের বড়পোশলা এবং মঙ্গলকোটের ছোটপোশলা, মুশারু ও পলসোনা গ্রামে এখনও ঝাঁকলাই সাপ দেখা দেয়। এই গ্রামগুলিতে এদিন জ্যান্ত ঝাঁকলাই সাপকেই দেবীজ্ঞানে পুজো করা হল।
এলাকার বাসিন্দাদের বিশ্বাস ঝাঁকলাই বিষধর হলেও সে কাউকে ছোবল মারে না। কোনও কারণে কাউকে ছোবল দিলে দেবীর মন্দিরের মাটি তার শরীরে লেপে দিলেই তিনি বিষমুক্ত হয়ে যান। এই বিশ্বাস আঁকড়ে আজও ঝাঁকলাই সাপকে সঙ্গে নিয়েই ঘর করেন এইসব গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, তাঁদের গ্রামে রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর এবং গ্রামের মন্দির, সর্বত্রই বিষধর কেউটে প্রজাতির ঝাঁকলাই সাপের অবাধ বিচরণ দেখা যায়।
গ্রাম গুলিতে এই ঝাঁকলাই সাপ নিয়ে অনেক লোককথা প্রচলিত আছে। এলাকার বাসিন্দাদের বিশ্বাস ঝাঁকলাই আসলে ‘কালনাগিনী’। লক্ষ্মীন্দরকে লোহার বাসরঘরে দংশন করার পর পালানোর সময় বেহুলা তাঁকে লক্ষ্য করে ‘কাজললতা’ ছুড়ে মারেন। ‘কাজললতার’ আঘাতে কালনাগিনীর ‘লেজ’ কেটে যায়। ঝাঁকলাইয়েরও ‘লেজ’ তাই কাটা।
পলসোনার বাসিন্দাদের কথায় এও জানা যায়, পলসোনা গ্রামে একটা ’ডাঙা’ আছে। সেই ‘ডাঙার’ নাম ‘খুনগোর’। বেহুলার ‘শাপে’ কালিয়াদহের কালনাগিনী মর্তে এসে ‘খুনগোর ডাঙায়’ বসবাস করতে শুরু করেন। গ্রামের বাসিন্দা মুরারীমোহন চক্রবর্তীকে স্বপ্নাদেশে কালনাগিনী তাঁর পুজো করার কথা জানা। সেই থেকেই পলসোনা গ্রামে ঝাঁকলাইয়ের পুজো হয়ে আসছে। আরও জানা যায়, ঝাঁকলাইয়ের গায়ের রং কালচে বাদামি।
যেসব গ্রামে ঝাঁকলাই সাপ দেখা যায় সেইসব গ্রামে সচরাচর অন্য কোনও বিষধর সাপ দেখা যায় না। ঝাঁকলাই রাতে বের হয় না। এমনকি এই সাপ এলাকা ছেড়েও কোথাও যায় না।
ঝাঁকলাই নিয়ে গ্রামের মানুষজনের ধর্মীয় বিশ্বাস যাই থাক বিজ্ঞানমঞ্চ বিষয়টিকে অন্য ভাবে দেখতেই আগ্রহী। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞানমঞ্চের বর্ধমান জেলা কার্যকরী সভাপতি চন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলেন, “সাপ এমনিতেই ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণী। কোনও কারণ ছাড়া সাপ কামড়ায় না। তাছাড়া ধর্মীয় রীতিনীতির কারণে ভাতার ও মঙ্গলকোটের ওই সাতটি গ্রামের মানুষ সাপকে বিরক্ত করেন না। সেই কারণে উভয়ের মধ্যে সহাবস্থান তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিনের সহাবস্থানের ফলে ওইসব গ্রাম গুলিতে সাপের কামড়ের ঘটনা খুবই কম। তবে এই সাপের বিষ আছে। কামড়ালে হাসপাতালে যেতে হবে।”