গৌতম দাস, তুফানগঞ্জ: পরিস্থিতি পুরোটাই বদলে গিয়েছে। একসময়ের রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত স্কুল আজ পড়ুয়াশূন্য। অথচ এমনটি হওয়ার কিন্তু কোনও কথাই ছিল না। এই স্কুল থেকে পড়াশোনা করে অনেকে শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, আইনজীবী হয়েছেন। পরে একটা সময় স্কুলের খুঁড়িয়ে চলা শুরু হয়। গত বছর দুজন ছাত্র থাকলেও এবছর এপ্রিল মাস একজন ছাত্র ছিল। তুফানগঞ্জ পুরসভার (Tufanganj) ৫ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত তুফানগঞ্জ টাউন বিদ্যাসাগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সবেধন নীলমণি সেই ছাত্রও পরে অন্য স্কুলে চলে যায়।
একা শিক্ষিকা স্কুলে এসে বসে থাকেন। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন ধরে ফাঁকা বসে থাকতে কারই বা ভালো লাগে! স্কুলের ইনচার্জ অপর্ণা নন্দীর কথায়,
‘২০২৪ সালে এই স্কুলে যোগ দিই। সেবার দুজন পড়ুয়া ছিল। এবছর তা কমে একজনে গিয়ে দাঁড়ায়। একা একা পড়াশোনা করতে তার ভালো না লাগায় ওই পড়ুয়াকে অন্য স্কুলে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছে। আমিও অন্য স্কুলে চলে যেতে চাই। গোটা বিষয়টি ওপরমহলকে জানানো হয়েছে।’ তুফানগঞ্জ-২ সার্কেলের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক প্রিয়ংবদা মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘সবকিছু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা যেভাবে নির্দেশ দেবে সেইমতো পদক্ষেপ করা হবে।’
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি এই প্রাথমিক স্কুলের পথচলা শুরু। এই স্কুল তৈরিতে শিক্ষানুরাগী ভানুপ্রকাশ দে মূল ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তুফানগঞ্জ টাউন গভর্নমেন্ট প্রাইমারি স্কুলে সকালে এই বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন চলত। পরবর্তীতে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে স্থায়ীভাবে স্কুল ভবন তৈরি করা হয়। সেসময় তুফানগঞ্জ পুরসভার সমস্ত ওয়ার্ড থেকেই কমবেশি ছাত্রছাত্রী এখানে ভর্তি হত। স্কুলের দারুণ সুনাম ছড়ানো শুরু করে। ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ভানুপ্রকাশ দে দিল্লি থেকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের পাশাপাশি এই স্কুলের সাফল্যের ঝুলিতে আরও অনেক পুরস্কার রয়েছে। ভানুবাবু ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সামলেছেন। সে সময় স্কুলে ৪০০-রও বেশি পড়ুয়া, তিনজন শিক্ষক। আজ তিনি রোগভোগে বাড়িতে শয্যাশায়ী। স্কুলের বর্তমান দশায় আরও কষ্ট পাচ্ছেন, ‘আমার নিজের হাতে তৈরি করা স্কুলটিকে যে করেই হোক টিকিয়ে রাখতে হবে। সুস্থ থাকলে এই স্কুলটিকে বন্ধ হতে দিতাম না।’ শিক্ষক কিশোর রায় বললেন, ‘১৯৯২ সাল পর্যন্ত এই স্কুল থেকেই প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা করেছি। খুব ভালো পড়াশোনা হত। শিক্ষকরাও খুব যত্ন করে পড়াতেন।’ এই স্কুলের ছাত্র তথা আইনজীবী শুভময় সরকারেরও একই বক্তব্য।
অথচ স্কুলে পরিকাঠামোর কোনও ঘাটতি ছিল না। শ্রেণিকক্ষের দেওয়ালে স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধি, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের ছবি জ্বলজ্বল করছে। রয়েছে দেওয়ালজুড়ে মূল্যবান সমস্ত বাণী। অন্যান্য পরিকাঠামোও ঠিকঠাক। তবুও স্কুলের এহেন হাল কেন? অন্দরান ফুলবাড়ি হরিরধাম হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক অমরেন্দ্র বসাক বললেন, ‘বর্তমানে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষদেরও ভরসা নেই। তাই দিন-দিন ছাত্রসংখ্যা কমতে শুরু করেছে।’ তুফানগঞ্জ টাউন বিদ্যাসাগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক অরিন্দম রায়ের বক্তব্য, ‘২০০৮ সাল থেকে গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এই স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। শেষের কয়েক বছর একাই ছিলাম। ২০০৮ সালে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১২৫ ছিল। তারপর থেকে প্রতিবছর কমতে কমতে এবছর শূন্য হয়েছে। বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষক ঘাটতি থাকার কারণে অভিভাবকরা ছাত্রভর্তি করাতে চাইতেন না।’ এক শিক্ষকের কথায়, ‘ শিক্ষকদের দিয়ে ভোটের কাজ করানোয় তাঁরা পঠনপাঠনে সময় দিতে পারছেন না। এসব কারণেই সরকারি বিভিন্ন স্কুলে পড়ুয়াদের সংখ্যা কমছে।’