সাগর বাগচী, শিলিগুড়ি: কসবা কাণ্ডের পর কলেজে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগে (Short-term employees recruitment) তৃণমূল নেতাদের ছড়ি ঘোরানোর একের পর এক অভিযোগ সামনে আসছে। এবার শিলিগুড়ি কলেজে (Siliguri Faculty) বিভিন্ন সময় তৃণমূল নেতাদের (TMC) নিকটাত্মীয় বা কাছের লোককে নিয়োগ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। ওই কর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আদৌ নিয়ম মানা হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
কলেজে ২৯ জন অস্থায়ী কর্মী কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি জয়ন্ত করের ও শিলিগুড়ি পুরনিগমের মেয়র পারিষদ দুলাল দত্তের দুই আত্মীয় রয়েছেন। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের এক নেতাকেও কলেজে অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। পাশাপাশি আরও কয়েকজন তৃণমূল নেতার ঘনিষ্ঠরা কাজ পেয়েছেন। এঁদের সকলের বেতন কলেজের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হয়। যদিও অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ তাঁর সময় হয়নি বলেই দায় এড়াতে চেয়েছেন শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ সুজিত ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘অধ্যক্ষ হিসাবে কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকেই এই কর্মীদের কলেজে কাজ করতে দেখছি। কীভাবে নিয়োগ হয়েছে, তা আগে যাঁরা বোর্ডে ছিলেন, তাঁরাই বলতে পারবেন। নিয়োগের বিষয়ে যদি তদন্তের নির্দেশ আসে, তবে তা দেখা হবে।’
ওই ২৯ জন অস্থায়ী কর্মী কলেজের ল্যাবরেটরিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট, গ্রন্থাগার ও অফিসে কর্মরত। শিলিগুড়ি পুরনিগমের মেয়র পারিষদ দুলাল দত্তের ভাইঝি রিঙ্কু দত্ত শিলিগুড়ি কলেজের গ্রন্থাগারে অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কাজ করছেন। তাঁর নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রিঙ্কু বলেন, ‘সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেখে লিখিত পরীক্ষা, ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে চাকরি পেয়েছি। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি। দুলাল দত্তের ভাইঝি হলে কি আমার যোগ্যতা থাকবে না? কোথাও তো দুলাল দত্তের ভাইঝি হিসাবে পরিচয় দিই না। কলেজে তো দাপিয়ে বেড়াই না। কিছু বিজেপির লোক ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করছে।’ গ্রন্থাগারে অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কাজ করছেন কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি জয়ন্ত করের আত্মীয় স্বপ্না দে। নিয়োগের বিষয়ে স্বপ্না বলেন, ‘জয়ন্ত কর আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হন। তিনি সভাপতি হওয়ার আগে কলেজে চাকরি পেয়েছি। ২০১৫ সালে বিজ্ঞপ্তি বেরিয়ে ছিল। তারপর ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি হয়। ২০১৬ সালে কাজে যোগ দিই। গোটা নিয়োগ পদ্ধতি মেনেই সব হয়েছে।’
শিলিগুড়ি কলেজের প্রাক্তন সহকারী সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত দাস বর্তমানে কলেজে গ্রুপ-ডি অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কাজ করছেন। পাশাপাশি সুদীপ্ত কলেজে ক্যান্টিন চালান। এখনও তিনি তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা হিসেবেই পরিচিত। কলেজে কিংবা বাইরে মিছিলেও হাঁটতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। অভিযোগ, কলেজে কোনও সমস্যা হলে কর্তৃপক্ষ তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন শলাপরামর্শ করে। সেই সুদীপ্ত নিয়োগ নিয়ে বলেন, ‘চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করেছিলাম। মাধ্যমিক চাকরির জন্য সর্বোচ্চ যোগ্যতা ছিল। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চাকরি হয়েছে। চাকরি পেতে সংগঠন বা দলের প্রভাব ছিল না।’
যদিও বিষয়টি নিয়ে শিলিগুড়ি পুরনিগমের বিরোধী দলনেতা অমিত জৈন বলেন, ‘তৃণমূলের নেতাদের নিকটাত্মীয়দের কলেজে নিয়োগ করা হয়েছে। তৃণমূল নেতারাও সেখানে অস্থায়ী কর্মী হিসাবে চাকরি করছেন। এরা কলেজে বিশৃঙ্খলার পরিবেশ তৈরি করছে। শিলিগুড়ি কলেজেও তাই হয়েছে। এদের নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কলেজে নিয়োগ করতে হলে নিরপেক্ষদের নিয়োগ করা হোক।’
শিলিগুড়ি কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি থাকাকালীন শিলিগুড়ি পুরনিগমের চেয়ারম্যান প্রতুল চক্রবর্তীর কাছে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তৃণমূলের থেকে সুপারিশ জমা পড়েছিল। কিন্তু তাতে তিনি স্বাক্ষর করেননি। কিন্তু এরপর প্রতুলকে অজ্ঞাত কারণে কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি প্রতুল চক্রবর্তী বলেন, ‘আইনত যা করা দরকার ছিল সেটাই করেছি। নিয়োগের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’ অন্যদিকে মেয়র পারিষদ দুলাল দত্ত বলেন, ‘আমার ভাইঝি অনেক আগেই যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছে। সেখানে আমি কিছুই করিনি।’
প্রতুল চক্রবর্তীকে সরিয়ে ২০১৬ সালে শিলিগুড়ি কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হিসাবে জয়ন্ত করকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর আমলেই অনেক অস্থায়ী কর্মীর নিয়োগ হয় বলে খবর। এর আগে জয়ন্তর বিরুদ্ধে সভাপতি পদে থেকে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার একাধিক অভিযোগ উঠেছে। কলেজের শিক্ষক সমিতি জয়ন্তকে সভাপতি পদ থেকে সরাতে মুখ্যমন্ত্রীকেও চিঠি দিয়েছে। এদিকে, অস্থায়ী কর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে আদৌ কোনও নিয়ম মানা হয়েছিল কি না তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। যদিও নিয়োগ নিয়ে জয়ন্ত করের মতামত জানতে তাঁকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পাশাপাশি অস্থায়ী কর্মীদের কেউ নিয়োগ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি।