দীপায়ন বসু, শিলিগুড়ি : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ সালের ১৬ জুন মারা যান। সবাই খুব কেঁদেছিলেন। ঠিক ১০০ বছরে একই দিনে আবারও অনেকের চোখে জল। নেপথ্যে সেই দেশবন্ধুই। আরও ভালো করে বলতে গেলে তাঁর ছবি ও কয়েকটি মালা।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দেশবন্ধুর অবদান কী তা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। দার্জিলিংয়ের বাড়িতে মারা যাওয়ার পর তাঁর মরদেহ টয়ট্রেনে করে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনে নিয়ে আসা হয়েছিল। তারপর অন্য ট্রেনে কলকাতা রওনা। শিয়ালদা পৌঁছানোর আগে সেই ট্রেন যতগুলি স্টেশনে থেমেছিল, মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল নামে। তাঁর মরদেহ নিয়ে ট্রেনটি কলকাতা রওনা হওয়ার আগে সেই ঢল শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনেও নেমেছিল। শহর কিন্তু সেই স্মৃতিকে বুক দিয়ে আগলে রাখেনি। এই স্টেশনে কত মনীষীর পা পড়েছে তা নিয়ে মাঝেমধ্যে নানা জায়গাই কথা হয়, কাজের কাজটি হয় না। বছর দশেক আগে বেশ কয়েকটি ছবির পাশাপাশি দেশবন্ধুর একটি ছবিও এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে টাঙানো হয়। সময়ের কোপে অন্য ছবিগুলি ঝরে গেলেও দেশবন্ধুর বহুবিবর্ণ ছবিটি আজও কোনওমতে টিকে। দার্জিলিংয়ে তোলা সেই ছবিতে দেশবন্ধুর পাশাপাশি মহাত্মা গান্ধি ও অ্যানি বেসান্তরাও আছেন।
মানুষটির মৃত্যুর শতবর্ষে সেই ছবি কেমন সমাদর পাচ্ছে তা দেখতে এদিন টাউন স্টেশনে যাওয়া হয়েছিল। বেলা ১১টা নাগাদ সেই ছবির নীচে তখন ফাঁকা। আশপাশে গুটি কয়েকজন আড্ডা মারতে ব্যস্ত। এমন এক স্মরণীয় দিনে এহেন স্মরণীয় ছবিকে ঘিরে এহেন নিস্পৃহ মনোভাব এদিন সেই ছবি দেখতে যাওয়া একজনকে বেশ আঘাত করেছিল। সেই মন খারাপ কাটাতে খানিক বাদে নিজের উদ্যোগে জুঁই, বেল ফুল আর গাঁদার মালা নিয়ে সেখানে হাজির হন।
প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে প্রায় ফুট দশেক উঁচুতে থাকা ছবির নাগাল পাওয়া সহজ নয়। অতএব, সেই ছবির বেশ কিছুটা নীচে থাকা, দেওয়ালের গায়ে গজানো একটি গাছের ডালে কোনওমতে মালা দেওয়ার চেষ্টা। তারপর? যা হল, একদম সিনেমার মতোই। ‘স্যর, মালা দেবেন?’ দাঁড়ান, দাঁড়ান, আসছি।’ সেই আড্ডার দলেরই একজন কয়েক সেকেন্ডে হাতলভাঙা এক চেয়ার নিয়ে হাজির। তাতে উঠেই ছবিতে মালা দেওয়ার চেষ্টা চলল। কিন্তু তিন ফুটের সেই চেয়ার বড্ড নীচু। সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্টেশন চত্বরেই ব্যবসা সামলান। ভাঙাচোরা চেয়ার নিয়ে তিনিই হাজির হয়েছিলেন। ‘কয়েক সেকেন্ড দিন’ বলে তিনি আবার হাওয়া। খানিকক্ষণ বাদে এবারে এক ভাঙাচোরা মই নিয়ে তিনি ময়দানে। তাতে সেই মানুষটিকে উঠতে বলা। চেয়ারে ওঠা সহজ, কিন্তু দেওয়ালের গায়ে আড়াআড়িভাবে রাখা মইয়ে চড়াটা…। অতএব সেই চেষ্টাই ইতি। কিন্তু ছবিতে মালা দেওয়ার কী হবে?
দেশবন্ধু একতার স্বপ্ন দেখতেন। এদিন তাঁর সেই ছবি দেশবন্ধুরই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখল। সুরজিতের বন্ধু খোকন স্টেশন চত্বরে পার্কিং লটের দায়িত্ব সামলান। সবাই মিলে সেই মইয়ে উঠলেন। খোকন সবার আগে। একবার পড়েও যাচ্ছিলেন। বাকিরা কোনওমতে সামলালেন। তারপর সবার মিলিত চেষ্টাই সেই ছবিতে মালা পড়ল। ততক্ষণে সেই জায়গায় বেশ ভিড় জমে গিয়েছে। ছবিতে মালা পড়ার মুহূর্তেই হাততালি পড়ল চটপট। ভিজে গেল কারও কারও চোখের কোণ।
কার ছবিতে মালা পড়ল জানেন? সুরজিৎ অপকট, ‘আমরা তো এটা গান্ধিজির ছবি বলেই জানতাম। এ ছবি যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের তা তো কেউ আমাদের জানাননি।’ বস্তুত, দেশবন্ধুকে কেন্দ্র করে এদিন শহরের কোথাও কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। কিছুটা দূরেই তাঁরই নামাঙ্কিত যে উড়ালপুল, সেখানেও কারও কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
এহেন দৃশ্য যে কারও মন খারাপ করবে। কিন্তু তাঁর ছবি ঘিরে এদিন সুরজিৎ, খোকনরা যা করে দেখালেন তা নিশ্চয়ই দেশবন্ধুকে কিছুটা হলেও তৃপ্তি দেবে। তাঁর প্রয়াণের শতবর্ষে সেটাই হয়তো শহর শিলিগুড়ির প্রাপ্তি।