দীপঙ্কর মিত্র, রায়গঞ্জ: নন্টে-ফন্টের ফচকেমি আজ অতীত। পাণ্ডব গোয়েন্দার গল্প গড়াগড়ি খায় গ্রন্থাগারে। এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের অধিকাংশই সেসব থেকে শতহস্ত দূরে। এখন হাতের মুঠোয় স্মার্ট ফোন। তাতেই বুঁদ হয়ে থাকছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। বাড়ি থেকে ফোন না পেলে বন্ধুরা চাঁদা তুলে ফোন ভাড়া নিয়ে দেখছে অশ্লীল ভিডিও, খেলছে ফ্রি ফায়ার গেম। চমকে দেওয়ার মতো এমনই একটি ঘটনা সামনে এল রায়গঞ্জে।
শহরের একটি নামিদামি স্কুলের ঘটনা। ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির কয়েকজন পড়ুয়া ১০০ টাকায় ভাড়া করা মোবাইল নিয়ে এসে স্কুলের শৌচাগারে অশ্লীল ভিডিও দেখার পাশাপাশি ফ্রি ফায়ার গেম খেলছিল। শুক্রবার অষ্টম শ্রেণির এমনই তিন পড়ুয়াকে শৌচাগারের ভিতর থেকে মোবাইল সহ হাতেনাতে ধরেন শিক্ষকরা। এরপর অভিভাবকদের স্কুলে ডেকে ছেলেমেয়েদের কুকীর্তির কথা জানানো হয। সন্তানের রসাতলে যাওয়ার কথা শুনে এক অভিভাবক কেঁদে ফেলেন। শিক্ষকদের সামনেই তাঁরা তুমুল শাসন শুরু করেন নিজের ছেলেমেয়েদের।
ওই পড়ুয়াদের জেরা করে জানা যায়, বাড়িতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ না পেয়ে নিজেরা চাঁদা তুলে ১০০ টাকায় ভাড়া করে স্কুলের শৌচাগারকেই বেছে নেয় মোবাইল দেখার জায়গা হিসেবে। শুধু স্কুল শৌচাগার নয়, বাড়ি ফেরার পথে এবং প্রাইভেট টিউশন পড়তে গিয়েও মোবাইল ফোনে বুঁদ হয়ে থাকছে তারা। অশ্লীল ভিডিও এবং গেম খেলার জন্য তারা ঘণ্টা প্রতি হিসেবে মোবাইলের ভাড়া নিচ্ছে। অভিভাবকদের একাংশের অভিযোগ, প্রায়ই টিফিন খাওয়ার নাম করে টাকা চায় ছেলেমেয়েরা। তা না দিলে শুরু হয় অশান্তি। কেউ টাকা চুরি করছে, কেউ আবার টিউশনের টাকা না দিয়ে সেই টাকা দিয়ে মোবাইল ভাড়া নিয়ে গেম খেলছে। অনেক অভিভাবকই তাঁদের সন্তানদের এমন কুকীর্তির কথা জানতেনই না। শুক্রবার স্কুলে গিয়ে সব জানতে পারার পর সকলেই হতবাক।
ঘটনা প্রসঙ্গে রায়গঞ্জ করোনেশন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কালীচরণ সাহার মন্তব্য, ‘এটা একটা অশনি সংকেত। ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে বলা মুশকিল। তবে আমরা স্কুলে মোবাইল ব্যবহার নিয়ে কঠোর। যারা মোবাইল নিয়ে আসে তাদের জমা রাখতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের মধ্যে মোবাইল নিয়ে আগ্রহটা বেশি। তাই তাদের নজরে রাখতে হয়। বাবা-মায়ের উচিত ছেলেমেয়েদের দিকে নজর রাখা। শুনতে পাচ্ছি পঞ্চম শ্রেণির বাচ্চারা স্কুলে এসে বিড়ি খাচ্ছে। পরিবেশ নষ্ট করছে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।’
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাভবনের প্রধান শিক্ষক সৌমিত্র তরফদার বক্তব্য, ‘ছাত্র সমাজকে সঠিক দিশা দেখানোই আমাদের কাজ। আমাদের সব বিষয়ে অবগত থাকতে হবে। অভিভাবক ও বাচ্চাদের নিয়ে বসে কুফলগুলি বোঝাতে হবে। মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের যেসব কৌতূহল আছে সেগুলো অবগত করা দরকার।’
ঘটনার কথা শুনে আঁৎকে উঠেছেন রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ চন্দন রায়ও। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি মোবাইল ফোনের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনতে না পারি তবে তা ড্রাগের নেশার চেয়ে ভয়ংকর আকার নেবে। আগামী প্রজন্ম বিপথগামী হয়ে ধ্বংসের মুখে চলে যাবে। বাবা-মায়ের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও আরও সচেতন ও দায়িত্ববান হতে হবে। সরকারিভাবেও এই নিয়ে প্রচার ও প্রয়োজনে বাচ্চাদের কাউন্সেলিং করা দরকার।’