শুভঙ্কর চক্রবর্তী ও এম আনওয়ারউল হক, শিলিগুড়ি ও বৈষ্ণবনগর : মালদার কালিয়াচক-৩ ব্লকের বীরনগর–২ গ্রামের প্রান্তিক চাষি আজিজুল শেখ। বাপঠাকুরদার রেখে যাওয়া কয়েক বিঘা জমিতে চাষাবাদ করে কোনওরকমে সংসার চালান। আপাতত তিনি নিঃস্ব। একচিলতে ভিটে ছাড়া আর কিছুই নেই তাঁর। আবাদি জমি যা ছিল পুরোটাই গ্রাস করেছে গঙ্গা। তবে কয়েকদিনের ভাঙনে সব হারানো আজিজুলের কান্নার আওয়াজ পৌঁছায়নি রাজধানী কলকাতায়। তাঁর চোখের জল মোছাতে আসেননি উত্তরবঙ্গের কোনও নেতা, মন্ত্রী; মেলেনি ক্ষতিপূরণও। বুধবার নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন আজিজুল। বললেন, ‘চোখের সামনে সব শেষ হয়ে গেল। কীভাবে খাবার জুটবে তাও জানি না।’
রেকর্ড বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত কলকাতায় হিসেব কষা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই দুর্যোগে মৃতদের ক্ষতিপূরণ ও চাকরির ঘোষণা হয়েছে। অন্যভাবে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদেরও ক্ষতিপূরণের আশ্বাস মিলেছে। একই রাজ্যের দুই প্রান্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিপূরণের ভিন্ন নিয়ম কেন, সেই উত্তর আজও মেলেনি। দক্ষিণের প্রাপ্তি আর উত্তরের বঞ্চনা নিয়ে প্রশ্ন আগেও উঠেছিল। তখনও নিশ্চুপ ছিলেন উত্তরের নেতারা। আজও তাঁদের মুখে কোনও কথা নেই। ২০২২-এর ১৭ এপ্রিল বিধ্বংসী ঝড়ে কোচবিহার-১ ব্লকের শুকটাবাড়ি, মোয়ামারি এলাকায় হাজারেরও বেশি বাড়িঘর ভেঙে যায়। এক রাতেই গৃহহীন মানুষগুলো আজও সরকারের তরফে কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি। স্থানীয় বাসিন্দা আজাদ মিয়াঁর আক্ষেপ, ‘সরকার শুধু কলকাতার কথাই ভাবে।’
মালদায় গঙ্গার মতো উত্তরবঙ্গের পাহাড় ও সমতলের একটা অংশে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে তিস্তা। ফি বছর তিস্তার স্রোতে ভেসে যায় অসংখ্য ঘরবাড়ি, ভাঙনে তলিয়ে যায় হাজার হাজার বিঘা আবাদি জমি, চা বাগান। তবে দাবি উঠলেও মেলে না ক্ষতিপূরণ। জলপাইগুড়ির ক্রান্তি ব্লকের চাঁপাডাঙ্গা, বাসুসুবা, মাস্টারপাড়া, কেরানিপাড়ার মতো এলাকাগুলি বর্ষার সময় প্রায় চার মাস জলবন্দি থাকে। সীমাহীন ক্ষতির মুখে পড়ে শ-পাঁচেক পরিবার। তবুও ক্ষতিপূরণ নয়, তাদের কপালে জোটে শুধুই আশ্বাস। কালিম্পংয়ের তিস্তাবাজার এবং লাগোয়া এলাকা কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আজও তাঁরা কোনও সরকারি ক্ষতিপূরণ পাননি বলেই জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা।
সামাজিক মাধ্যমে উত্তরের বঞ্চনা নিয়ে সরব মানুষের সংখ্যা কম নয়। তাঁরা যে বঞ্চিত সেকথা ঘুরিয়ে স্বীকার করেছেন জিটিএ-র চিফ এগজিকিউটিভ অনীত থাপা। তাঁর কথা, ‘রাজ্য সরকার কাজ করছে না তা নয়। তবে যতটা দরকার ততটা তো আমরা পাচ্ছি না। সত্যিই তিস্তাকে নিয়ে ভাবতে হবে।’ সভা সমিতিতে ভাষণ দিতে গিয়ে নিজেকে স্পষ্টবক্তা বলেই দাবি করেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ। বঞ্চনার প্রশ্নে তাঁর গলায় দায় এড়ানোরই সুর। উদয়নের কথা, ‘কলকাতার জল জমার সমস্যার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের নদীভাঙনের সমস্যাকে গুলিয়ে ফেললে হবে না। নদীভাঙনের স্থায়ী সমাধান দরকার। তারজন্য কেন্দ্রের সহযোগিতা প্রয়োজন।’ দায় যে শুধু রাজ্যের নয় সে প্রসঙ্গও উঠেছে আলোচনায়। কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য রাজ্যের দায়বদ্ধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘কেন্দ্রীয় সরকার সব ক্ষেত্রেই পূর্ণ সহযোগিতা করছে এবং আর্থিক সহযোগিতা করছে। তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রীরা চুরি করে আর কাটমানি খেয়ে সব শেষ করে দিচ্ছে। রাজ্য তাদের দায়িত্ব পালন করলে উত্তরবঙ্গে এমন খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হত না।’
দায় ঠেলাঠেলি করলেও গঙ্গার গ্রাস থেকে বৈষ্ণবনগরের মানুষের রক্ষায় কার্যত কোনও পদক্ষেপই করা হচ্ছে না। টানা কয়েকদিনের প্রবল বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা অস্বাভাবিক জলের স্রোত গঙ্গাকে করেছে ভয়ংকর। বিপদসীমা ছুঁইছুঁই জলস্তর, নদীর ভাঙন গ্রাস করছে একের পর এক গ্রাম। বিশ্বকর্মাপুজোর দিন থেকে শুরু হওয়া ভাঙনে যেন বিরতি নেই। বসতবাড়ি, ফসলি জমি, গবাদিপশু, এমনকি গ্রামীণ রাস্তাঘাটও চলে গিয়েছে নদীগর্ভে। তাই অন্ধকার হলেই বাড়ছে আতঙ্ক। দিশেহারা অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে প্রতিদিনই গ্রাম ছাড়ছেন বহু মানুষ। হাজারো পরিবার আজ দিশেহারা। কেউ ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন, কারও চোখে ভয় ও জল। জীবনের অংশ হয়ে ওঠা গঙ্গাই আজ ছিনিয়ে নিচ্ছে বেঁচে থাকার ভরসা।
এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতেই শুক্রবার সন্ধ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে বৈষ্ণবনগরের বিধায়ক চন্দনা সরকার পা রাখলে তাঁকে ঘিরে ক্ষুব্ধ মানুষ বিক্ষোভ দেখান। অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে গঙ্গার ভাঙন চললেও প্রশাসন শুধু আশ্বাস দিয়েছে, স্থায়ী সমাধান হয়নি। বিধায়ক অবশ্য বলছেন, ‘প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস মিলেছে।’ কিন্তু স্থানীয়দের বক্তব্য, প্রতিবছরই একই কথা শোনা যায়। কিন্তু কাজ কিছুই হয় না। সাধারণ মানুষজন বলছেন, আসলে এটাই উত্তরবঙ্গের ভবিতব্য।