Naxalbari | বিপন্ন নদীয়ালি মাছ, নিঃশব্দে পেশা বদল

Naxalbari | বিপন্ন নদীয়ালি মাছ, নিঃশব্দে পেশা বদল

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


মহম্মদ হাসিম, নকশালবাড়ি: মৎস্য মারিব খাইব সুখে? সেসব দিন শেষ। মৎস্যদেবতা সহায় নন। নদীতে মাছের ঘরে অশনিসংকেত। মৎস্যজীবীদের সংসারেও ঘোর কলি। পেশা বদলের হিড়িক।

বছর ২০ আগেও খেমচি নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এই নদীতে মাছ ধরেই সংসার চলত রায়পাড়ার সুকরু খেরিয়ার। আর এখন? ৬৩ বছরের এই প্রৌঢ় বলছিলেন, ‘এই নদীর মাছ মারিয়া হামার সংসার চলত। আর অ্যালা নদীতে নামতেই সারা গতর চুলকানি ধরে লিছে।’ এখন বাধ্য হয়ে জীবিকা বদলেছেন। পাড়ায় একটি মুদি দোকানে কাজ করেন।

তারাবাড়ির বাবলু কিষানও একসময় খেমচি থেকে মাছ ধরে প্রতিদিন নকশালবাড়ি বাজারে পসরা সাজিয়ে বসতেন। আয় হত ভালোই। কিন্তু ১০ বছর হল, তিনি আর মাছ ধরেন না। শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।

গত কয়েক বছরে খেমচি নদীর ওপর নির্ভরশীল বহু মৎস্যজীবী জীবিকা বদলে ফেলেছেন। কিন্তু কেন? নদীর অবস্থা শোচনীয়। আবর্জনায় পরিপূর্ণ। মাছের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠেছে।

তাহলে কি আর কেউ মাছ ধরেন না? ধরেন বৈকি। যেমন কিলারামজোতের মহম্মদ সাদ্দাম। তবে আগে যে পরিমাণে তাঁর জালে মাছ উঠত, তা এখন আর ওঠে না। তা সত্ত্বেও প্রতিদিন সকালে জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। রোজ গড়ে এক থেকে দেড় কেজি মাছ ওঠে। সেটাই বাজারে নিয়ে আসেন সাদ্দাম।

কী কী মাছ ওঠে? সাদ্দাম জানালেন, ছোট ছোট পুঁটি, নদীয়ালি, ডেঁরা, ট্যাংরা, পয়া, চিংড়ি। মাঝেমধ্যে ৫০০-৬০০ টাকার হাজিরাও হয়ে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ দিন তা হয় না। অথচ আগে আয় অনেক ভালো হত। মাছ উঠত অনেক বেশি।

এখন তাহলে সমস্যা কোথায়? সাদ্দামের মতে, নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরার প্রথা দিন-দিন অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘অনেকে একসঙ্গে অনেক মাছ ধরার লোভে বিদ্যুৎ এবং কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। এতে কয়েকদিন প্রচুর মাছ উঠছে ঠিকই। কিন্তু এতে গোটা নদীতে মাছের বংশ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

সাদ্দামের অভিজ্ঞতা, কয়েকবছর আগেও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত এই নদীতে। এখন হাতেগোনা কয়েকটা প্রজাতিই অবশিষ্ট আছে। তাঁর আশঙ্কা, ‘এভাবে চলতে থাকলে আমাকেও হয়তো পেশা বদলাতে হবে!’

এই দুঃখের সময়েও ব্যতিক্রম আছে। খালবস্তির ধরণী দাস। বছর ৭০ ছুঁইছুঁই। এই বয়সেও রোজ রাতে নিয়ম করে নদীতে নামেন। প্রথা মেনে জাল ফেলে মাছ ধরেন। পরেরদিন সকালে বাজারে দেখা যায় তাঁকে। মৎস্যপ্রেমীদের কাছে তিনি সাক্ষাৎ দেবদূত। সবেধন নীলমণিও বলা যায়। কেন? একটাই কারণ, নদীয়ালি মাছ। বাজারে বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গেলেও একমাত্র ধরণীর কাছেই এই মাছ এখনও পাওয়া যায়।

শুধু নদীয়ালি? দেশি মাগুর, শিঙি, ট্যাংরা, পাথরচাটা, বালুতরী, চেপ্টি, বালু ট্যাংরা, বাম, গছি, পুঁটি, চ্যাং, টাকি এমনকি শোল মাছও ধরা পড়ে তাঁর জালে। নকশালবাড়ির মাছপ্রেমীরা বাজারে গিয়ে ধরণীর অপেক্ষায় থাকেন। মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় এই বৃদ্ধের ডালি। কিন্তু বাকিদের মতো ধরণীরও আক্ষেপের কারণ হয়ে উঠেছে নদীর বেহাল অবস্থা। এই বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘গোটা নদীতেই দূষণ। বিশেষ করে কয়েকটা জায়গায় দূষণ এতটাই মারাত্মক আকার নিয়েছে যে সেখানে আর মাছ পাওয়াই যায় না।’

নদীর ভূগোল দেখলেই দূষণের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। খালবস্তি থেকে খড়িবাড়ির দ্বারাবোকাস পর্যন্ত চার কিলোমিটার অঞ্চলে খেমচি নদী চা বাগান এবং জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তাই প্রাকৃতিক কারণে এই অংশের নদী অপেক্ষাকৃত কম দূষিত। এখানে কিছু মাছ এখনও পাওয়া যায়। নদীয়ালি, মাগুর, শোল, বাম, গছি মাছ রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়। তখনই এরা জালে ধরা দেয় বেশি। এই অঞ্চলটি বাদে বাকি কোথাও আর মাছেরা ভালোভাবে বসবাস করতে পারছে না বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন ধরণী।

ধরণীর থেকে নিয়মিত মাছ কেনেন স্থানীয় বাসিন্দা সুশান্ত বাড়ই। তিনিও আক্ষেপ করে বলছেন, ‘এখন বেশিরভাগ মাছই হাইব্রিড। সেই মাছের স্বাদ নেই বললেই চলে। দুই দশক আগেও বাজারে প্রচুর নদীয়ালি মাছ পাওয়া যেত। এখন এক-দুটো দোকান ছাড়া আর দেখতে পাই না।’

ধরণীর বয়স বাড়ছে। শরীর যতদিন চলবে, ততদিন নদীয়ালি মাছ উঠবে তাঁর জালে। তারপর? মাছের অস্তিত্ব থাকবে তো? সর্বোপরি নদীটার কী হবে? প্রশ্ন রয়েই গেল।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *