শুভজিৎ দত্ত: কী নেই ক্যাম্পাসে! স্মার্ট ক্লাস। স্মার্ট টিভিতে প্রেরণামূলক সিনেমা দেখানোর বন্দোবস্ত। জলপানের ওয়াটার রিংগিং বেল। গোটা চত্বরজুড়ে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারি। ছাত্র থেকে শিক্ষক, সকলের জন্য বায়োমেট্রিক অ্যাটেনড্যান্স। স্পোকেন ইংরেজি শেখানোর বিশেষ ক্লাস। প্রতি শনিবার আমন্ত্রিত শিক্ষকদের কাছ থেকে নাচ, গান শেখার সুযোগ। দুঃস্থ মেধাবীরা যাতে স্টাইপেন্ড (ন্যাশনাল মেরিট কাম মিনস স্কলারশিপ) পেতে পারে, সেজন্য অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের আলাদা কোচিং। সৌরবিদ্যুৎচালিত পানীয় জলের ব্যবস্থা থেকে ওয়াটার কুলার।
নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বার্থে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে আরও বহু কিছু। ঝাঁ চকচকে বেসরকারি স্কুলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিতে স্রেফ ইচ্ছেশক্তির ডানায় ভর করেও যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়, তার উদাহরণ ময়নাগুড়ি রোড হাইস্কুল। জেলার শিক্ষাকর্তারাও একবাক্যে সেই কথা মেনে নিচ্ছেন।
যদিও বছর তিনেক আগে পরিস্থিতি ঠিক এতটা ভালো ছিল না। হাল ফেরানোর শপথ নেন প্রধান শিক্ষক শুভময় ঘোষ। তাঁর উদ্যোগে শামিল হন বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির সভাপতি গোপালচন্দ্র সরকার সহ ২৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। এগিয়ে আসেন স্থানীয়রাও। তাঁরাই পরিকাঠামো উন্নয়নে আর্থিক এবং অন্যান্যভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। সেই স্কুল এখন রোল মডেল। চারদিকে সবুজের সমাহার। দেওয়ালে মনীষীদের বাণী। রংতুলির ছোঁয়ায় সেজে উঠেছে গোটা ভবন।
এ তো গেল বাইরের চাকচিক্য। পঠনপাঠনের মানোন্নয়নে খামতি রাখতে নারাজ স্কুল কর্তৃপক্ষ। সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করাই প্রথম লক্ষ্য। পড়ুয়াদের কী অবস্থা, সেটা তাদের অভিভাবককে ডেকে জানানো হয়। শৃঙ্খলাপরায়ণতার পাঠ দেন শিক্ষকরা। বার্নিশ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার এই বিদ্যালয়টিতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের সার্বিক ফলাফল প্রশংসনীয়। গত দু’বছর ধরে দুটো পরীক্ষাতেই পাশের হার ১০০ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে এখন মোট পড়ুয়া সংখ্যা ১,২৬৩। এর মধ্যে ছাত্রীসংখ্যা বেশি।
শুধু লেখাপড়া নয়, চরিত্র গঠনও সমানভাবে জরুরি। তাই পড়ুয়াদের মধ্যে সমাজ সচেতনতা গড়ে তুলতে চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে অষ্টম ও নবম শ্রেণির ১০০ পড়ুয়াকে নিয়ে চালু করা হয়েছে ন্যাশনাল ক্যাডেট কর্পস (এনসিসি)-এর কোর্স। গতবছর থেকে একাদশের ১০০ জন পড়ুয়াকে নিয়ে চলছে ন্যাশনাল সার্ভিস স্কিম (এনএসএস)। সেই বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে বার্নিশের বিধ্বস্তদের পাশে দাঁড়ানো হোক কিংবা পানীয় জলসংকট মেটানো, সাধারণকে সবুজায়নের গুরুত্ব বোঝানো থেকে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে কী করণীয় ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সচেতনতার প্রসারে স্কুলের এনএসএস ক্যাডেটরা কাজ করে চলেছে।
পণ্যের গুণগতমান যাচাইয়ের ধারণা গড়ে তোলা ও সমাজকে সচেতন করে তুলতে বিদ্যালয়ে গঠন করা হয়েছে ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ক্লাব। যার অধীনে বছরভর নানা কর্মসূচি হয়। ছবি আঁকা, প্রবন্ধ রচনার মতো প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
রয়েছে শিশু সংসদ। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছে দশম শ্রেণির অর্পিতা রায়। স্কুল ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় তাকে যোগ্য সঙ্গ দেয় দ্বাদশের রূপশ্রী পাল। সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন শিক্ষকরা। নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রকাশিত হয় দেওয়াল পত্রিকা ‘প্রত্যুষা’। সেখানে পড়ুয়াদের বাছাই করা লেখা জায়গা করে নেয়।
প্রতিদিন স্কুল শুরুর আগে প্রার্থনাপর্বে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি গাওয়া হয় দেশাত্মবোধক গান। একেকদিন একেকটি। বার্ষিক ফুড ফেস্টিভাল নিয়ে পড়ুয়াদের মতোই সমান উৎসাহী অভিভাবকরা। চলতি বছর জাতীয় স্তরের শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেসে স্কুলের ছাত্রী ভগবতী মণ্ডলের তৈরি করা পার্থেনিয়াম থেকে সার তৈরির মডেল তাক লাগিয়ে দিয়েছিল বিজ্ঞানীদের। প্রত্যেক পড়ুয়ার মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা গড়ে তুলতে আলোচনা, মডেল তৈরি সহ নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।