উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ১৫ জুন ছিল বিশ্ব বাবা দিবস। সন্তানের বাবা হওয়ার পথে যে সকল পুরুেষর রয়েছে বিশেষ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁদের নিয়েই বিশেষ প্রতিবেদন। লিখেছেন শিলিগুড়ির বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ ডাঃ প্রসেনজিৎকুমার রায়
অনেক পুরুষের জন্য বাবা হওয়ার যাত্রা কঠিন অভিজ্ঞতা হতে পারে, যা প্রায়শই নিঃশব্দে থেকে যায়। পুরুষ বন্ধ্যাত্ব একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা, যা বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ দম্পতিকে প্রভাবিত করছে। পুরুষ বন্ধ্যাত্বের (Male Infertility) কারণগুলো বহুস্তরীয়, যার মধ্যে রয়েছে-
জীবনশৈলী বিষয়ক: পরিবেশ দূষণ, ধূমপান, অতিরিক্ত তাপ ও কিছু ওষুধ শুক্রাণুর গুণমান ও সংখ্যা কমাতে পারে।
চিকিৎসাগত অবস্থা: সংক্রমণ, প্রজনন পথে বাধা বা আঘাত, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা কিংবা জেনেটিক সমস্যা।
বয়স: বেশি বয়সে জেনেটিক মিউটেশনের ঝুঁকি বাড়ে ও প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়।
পরিবেশগত কারণ: এন্ডোক্রাইন-ব্যবধানকারী রাসায়নিক (ইডিসি) ও অন্যান্য দূষকের প্রভাব।
মানসিক প্রভাব
পুরুষ বন্ধ্যাত্ব একজন পুরুষ ও তাঁর সঙ্গিনীর ওপর গভীর মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে। এই বিষয়ে সামাজিক কলঙ্কের কারণে অনেকসময় লজ্জা, অপরাধবোধ ও অক্ষমতার অনুভূতি দেখা দেয়। অনেক পুরুষ তাঁদের উদ্বেগ বন্ধু, সঙ্গী বা চিকিৎসকের সঙ্গে ভাগ করতে লজ্জা পান, ফলে মানসিক চাপ আরও বেড়ে যায়। তাই মানসিক দিকটিও গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া উচিত।
মূল কারণ উদ্ঘাটন
পুরুষ বন্ধ্যাত্ব নির্ণয়ে প্রয়োজন হয় একটি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন, যার মধ্যে থাকে –
বীর্য বিশ্লেষণ – বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী এবং একটি স্বীকৃত ল্যাব থেকে শুক্রাণুর সংখ্যা, গতি ও গঠন পর্যালোচনা করা হয়।
হরমোন পরীক্ষা – টেস্টোস্টেরন ও ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (এফএসএইচ)-এর মাত্রা পরিমাপ করে হরমোনের ভারসাম্য বিশ্লেষণ।
জেনেটিক পরীক্ষা – জেনেটিক অস্বাভাবিকতা বা মিউটেশন চিহ্নিত করে মূল কারণ জানা যায়।
ইমেজিং স্টাডিজ – আল্ট্রাসাউন্ড বা অন্যান্য চিত্রায়ণ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রজননপথের কোনও বাধা বা ত্রুটি চিহ্নিত হয়।
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনাঃ বহুমাত্রিক পন্থা
পুরুষ বন্ধ্যাত্ব নিরসনে বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি উপলব্ধ। সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক নিম্নলিখিত সুপারিশগুলি করতে পারেন –
জীবনধারা পরিবর্তনঃ ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন, সুষম ওজন বজায় রাখা, মানসিক চাপ কমানো – সবই উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে।
ওষুধঃ কিছু ওষুধ শুক্রাণুর সংখ্যা, গতি ও হরমোনের মাত্রা উন্নত করতে সহায়ক।
সার্জারিঃ প্রজনন পথে বাধা বা ভেরিকোসিল ঠিক করতে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে।
সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তিঃ আইইউআই বা আইভিএফের মাধ্যমে গর্ভধারণ সম্ভব।
আইসিএসআই (ইন্ট্রাসাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইনজেকশন) : একটি বিশেষ ধরনের আইভিএফ, যেখানে একক শুক্রাণু একটি ডিম্বাণুতে ইনজেক্ট করা হয়। এটি খুবই কার্যকর বিশেষ করে নীচের ক্ষেত্রগুলিতে –
১) গুরুতর পুরুষ বন্ধ্যাত্ব – যখন শুক্রাণুর সংখ্যা বা গতি খুবই খারাপ থাকে।
২) অবস্ট্রাকটিভ অ্যাজুস্পার্মিয়া – যেখানে শুক্রাণুর নালিতে বাধা থাকে বা অনুপস্থিত থাকে, তখন টেস্টিস থেকে অপারেশনের মাধ্যমে শুক্রাণু (টিইএসই) নিয়ে আইসিএসআই করা হয়।
৩) নন–অবস্ট্রাকটিভ অ্যাজুস্পার্মিয়া – যখন টেস্টিস নিজে শুক্রাণু তৈরি করতে অক্ষম, তখন অন্যান্য অত্যাধুনিক শুক্রাণু বাছাই পদ্ধতি, যেমন পিআইসিএসআই বা স্পার্ম সর্টার, আইভিএফের সাফল্য উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায়, এমনকি অ্যাজুস্পার্মিয়া রোগীদের মধ্যেও, যেখানে শুক্রাণু না থাকলেও পুরুষ জীববৈজ্ঞানিক বাবা হতে পারেন।
আমরা দম্পতিদের যেভাবে সাহায্য করতে পারি –
সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে – পুরুষ বন্ধ্যাত্ব, তার কারণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে কলঙ্ক দূর করা ও প্রাথমিক পদক্ষেপ করতে উৎসাহিত করা।
মানসিক সহায়তা দিয়ে – সহানুভূতিশীল ও গ্রহণযোগ্য পরিবেশ তৈরি করে মানসিক চাপ কমানো যায়।
খোলামেলা যোগাযোগে উৎসাহিত করে – সঙ্গী, চিকিৎসক ও সাপোর্ট গ্রুপের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা এই সমস্যা মোকাবিলায় সহায়ক।
এভাবেই আমরা পুরুষদের বাবা হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারি।