কল্লোল মজুমদার, মালদা: ছোটখাটো চেহারার টাকমাথার একটি মানুষ। পরনে সাদা গেঞ্জি। গলায় ঝুলছে রুদ্রাক্ষের মালা। হাতে কমণ্ডলু আর ত্রিশূল। মুখে মন্ত্রোচ্চারণ, ‘হিং-ক্রিং-ছট।’ সঙ্গীসাথিরা বাজিয়ে চলেছেন ডুগডুগি। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল সেই ‘সাধুবাবা’কে ঘিরে। সাধুবাবা কখনও আগুন মুখে পুরে নিচ্ছেন। কখনও বা নিজের শরীরে জ্বলন্ত মশাল বুলিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর চামড়া পুড়ছে না।
এমন তো অনেকেই করেন। গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে কেউ খেলা দেখান। কেউ কেউ আবার খেলা দেখানোর নাম করে লোক ঠকান। তাহলে এই সাধুবাবার বিশেষত্ব কী? তফাতটা উদ্দেশ্যে। এই সাধুবাবা নানা ধরনের ‘মাদারি কা খেল’ দেখান। আর ভিড় জমে গেলে সেই খেলার কৌশল হাতেকলমে শিখিয়ে দেন আমজনতাকে। সাধুবাবার উদ্দেশ্য একটাই, ভণ্ড সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে গ্রামের সরল সাদাসিধে মানুষগুলো যেন প্রতারিত না হন।
এই সাধুবাবার নাম কমলেশ্বরীপ্রসাদ সিং। বছর আটষট্টির এই ব্যক্তি এককালে মালদা শহরের (Malda) জহরমল শেঠিয়া হিন্দি হাইস্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন। কিন্তু আমজনতাকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার এবং বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার তাঁর প্রচেষ্টা থেমে নেই। মালদা শহরের দক্ষিণ বালুচরের তাঁর বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল। কমলেশ্বরীর জন্ম বিহারের ভাগলপুরে। অল্পবয়সেই বাংলায় চলে আসেন। পড়াশোনা শেষে শুরু করেন শিক্ষকতা। বহুদিন আগে রাজকুমার নামে এক ব্যক্তি এই ধরনের বুজরুকি দেখিয়ে মানুষকে ঠকাতেন। তার কাছে তিনি যেতে শুরু করেন। আস্তে আস্তে শিখে নেন কৌশল। ঠিক সেই সময় মালদায় আসেন বিশ্ববিখ্যাত জাদুকর সিনিয়ার পিসি সরকার। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান কমলেশ্বরী। তবে জাদুকর বেশি সময় দেননি। সুযোগ পেয়ে কমলেশ্বরী জানতে চান, ‘জাদুর সঙ্গে তন্ত্রমন্ত্রের কি কোনও সম্পর্ক রয়েছে?’ কোনও কথা না বলে সিনিয়ার পিসি সরকার শুধু হাতের আঙুল দিয়ে বাতাসে একটি গোল চিহ্ন এঁকে দেন। কমলেশ্বরী বুঝে যান জাদুকরের কথা। আর ঠিক করে নেন, বাকিদেরও বোঝাবেন।
মালদায় বিজ্ঞান মঞ্চ গড়ে ওঠার পর তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন কমলেশ্বরী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি সেই সংগঠনের জেলা সভাপতিও ছিলেন। মালদা বিজ্ঞানমঞ্চের সম্পাদক মনোরঞ্জন দাসের কথায়, ‘এই মানুষটি ছাড়া আমরা এক পা-ও চলতে পারি না।’
সালটা ১৯৯৭। মালদার গাজোলে শুকানদিঘিতে ডাইনি অপবাদ দিয়ে খুন করা হয় একই পরিবারের ছয়জনকে। সেই সময় আসরে নামে বিজ্ঞানমঞ্চ। মুখ্য ভূমিকা নেন কমলেশ্বরী। সাধু সেজে মাসের পর মাস ধরে শুকানদিঘিতে পড়ে থাকেন। এলাকার আদিবাসী বাসিন্দাদের সামনে সাধুবেশে জাদু দেখিয়ে, সেসবের কৌশল ফাঁস করে সচেতন করেন। এখনও পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি অনুষ্ঠান করে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। এজন্য তাঁকে আক্রমণের মুখেও পড়তে হয়েছে। একবার এক খাজাবাবার বুজরুকি ধরে ফেলায় গ্রামের অসচেতন মানুষ ঘিরে ফেলেছিল। মেরে ফেলার চেষ্টাও করা হয়। কোনওরকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান।
তাঁর ধ্যান-জ্ঞানে কেবল বিজ্ঞানের রহস্য আর সচেতনতার কথা। কমলেশ্বরীর সঙ্গে কথা বললেই উঠে আসে তন্ত্রমন্ত্রের পর্দাফাঁসের প্রসঙ্গ। সাদা ফুলের ওপর কীভাবে ফেনপথলিন লাগিয়ে, সাবান জলের ছিটে দিয়ে লাল করে দেওয়া হয়, সেকথা বলে দেন। কোড ল্যাঙ্গুয়েজের সাহায্যে যে চোখে কাপড় বেঁধেও সবকিছু বলে দেওয়া যায়, জলের মতো বুঝিয়ে দেন কমলেশ্বর। যেভাবে এতদিন বুঝিয়ে আসছেন আমআদমিকে।