অরিন্দম বাগ, মালদা: পুরোপুরি উলটো ছবি।
যেখানে দিনের পর দিন বাড়িতে প্রসবের সংখ্যা কমছে, সেখানে মালদা জেলার (Malda) গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জন্ম সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশনের (Delivery certificates registration) সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এই জেলায় পঞ্চায়েত দপ্তর থেকে জন্মের রেজিস্ট্রেশন সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার বেড়েছে। চলতি বছরের পরিসংখ্যান অনেকটাই ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে মানিকচকের উত্তর চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত ও ইংরেজবাজারের যদুপুর–১ গ্রাম পঞ্চায়েতের পরিসংখ্যান ‘সন্দেহজনক’। বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে বিজেপির দাবি। অন্যদিকে, ডিজিটাইজেশনের হিড়িকেই এমনটা হচ্ছে বলে জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর মনে করছে। জেলা শাসক নীতিন সিংহানিয়ার বক্তব্য, ‘এই বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তে কোনও গাফিলতি পাওয়া গেলে কঠোর পদক্ষেপ করা হবে।’
মালদা জেলায় ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত দপ্তর থেকে ৪৪ হাজার ২২৯টি জন্ম সার্টিফিকেট ইস্যু হয়েছিল। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা প্রায় ৫৬ হাজার হয়। চলতি বছরের জুলাই মাসের মাঝামাঝিতেই সেই সংখ্যাটা ২৩ হাজার ২৬-এ পৌঁছে যায়। মানিকচকের উত্তর চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি ‘সন্দেহজনক’। ওই গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে ২০২২ সালে ৫৩৬টি রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল, ২০২৩ সালে ৫৩৮টি। অদ্ভুতভাবে ২০২৪ সালে এই গ্রাম পঞ্চায়েত থেকেই ৪৫৪৭টি রেজিস্ট্রেশন হয়, চলতি বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেই সংখ্যা ৩২৪০-এ পৌঁছেছে। উত্তর চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে গত তিন বছরের প্রতি মাসের রেজিস্ট্রেশনের গড় সংখ্যা ১৯৫ ছিল। সেখানে শুধুমাত্র চলতি বছরের মার্চ মাসে ৭২৭টি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। ২০২৩ সালে ইংরেজবাজারের ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে মোট ১০ হাজার ৪১৭টি জন্মের রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল। সেখানে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৫টি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র যদুপুর-১ গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে ৩৭১৮টি জন্মের রেজিস্ট্রেশন হয়েছে।
সূত্রের খবর, ইতিমধ্যে এই দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে স্বাস্থ্য ভবন থেকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই মোতাবেক সংশ্লিষ্ট এলাকার বিডিওদের এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যদিও এনিয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকরা সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে দাবি করা হয়েছে, নার্সিংহোমে শিশুর জন্ম হলে সেই রেজিস্ট্রেশন পঞ্চায়েতের তরফেই করা হয়। যদুপুর–১ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় দিনের পর দিন নার্সিংহোমের সংখ্যা বাড়ছে। সেক্ষেত্রে ওই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা বাড়তে পারে। তাছাড়াও গত কয়েক বছরে মানুষের মধ্যে সার্টিফিকেট ডিজিটাইজেশনের হিড়িক বেড়েছে। পুরোনো সার্টিফিকেট জমা দিয়ে নতুন সার্টিফিকেট ইস্যু করার ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন নম্বর একই থাকে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতের রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা বেড়ে যায়।
যদুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নমিতা চৌধুরী বললেন, ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধনী (এসআইআর) নিয়ে অনেকের মধ্যে ভয় ঢুকে গিয়েছে। যে কারণে আগে যাঁরা জন্মের রেজিস্ট্রেশন করাননি, তাঁরাও এখনও রেজিস্ট্রেশনের জন্য আসছেন। আর সেই কারণেই জন্ম রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা এভাবে বেড়ে গিয়েছে।’ বহু চেষ্টা করেও উত্তর চণ্ডীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান অর্চনা মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
এদিকে, বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। বিজেপির দক্ষিণ মালদা সাংগঠনিক জেলা সভাপতি অজয় গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘যে সমস্ত পঞ্চায়েত এলাকায় জন্ম রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি হয়েছে, সেই সমস্ত পঞ্চায়েত এলাকায় একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের আধিপত্য বেশি। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ভারতবর্ষে ঢুকে যাওয়ার পর মালদা, মুর্শিদাবাদ, ২৪ পরগনা, বারাসত, বসিরহাটের মতো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই জন্ম রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। সেই কারণে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা সংশোধনের পরিকল্পনার সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করেছি।’ অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি আব্দুর রহিম বক্সীর কথায়, ‘এই বিষয়টির সঙ্গে আমি জড়িত নয়। তাই এধরনের কোনও তথ্য আমার কাছে নেই। আমার বিশ্বাস, জন্মের রেজিস্ট্রেশন পুরোপুরি স্বচ্ছতার সঙ্গেই চলছে। এর সঙ্গে অনুপ্রবেশ বা দুর্নীতির কোনও যোগ নেই।’ তবে বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।