সৌরভকুমার মিশ্র, হরিশ্চন্দ্রপুর: সম্প্রতি ভারত সরকার রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করায় আমেরিকার বিষনজরে পড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার ঘোষণা করেছে, ভারত থেকে আমদানি করা সামগ্রীর উপর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কর বসানো হবে। আর তাতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুরের মাখনা ব্যবসায়ীরা। আশঙ্কা, এতে এলাকায় মাখনা চাষ এবং উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি দাম পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর এলাকার অন্যতম অর্থকরী ফসল মাখনা। ভারত সহ ভিনরাজ্যে তো বটেই, বিদেশেও মাখনা রপ্তানি করা হয় এই এলাকা থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে সুপার ফুড হিসেবে মাখনার জনপ্রিয়তা রয়েছে। হরিশ্চন্দ্রপুর থেকে বিপুল পরিমাণে মাখনা রপ্তানি হয় সেখানে।
বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মাখনার উপর ৩.৫ শতাংশ হারে রপ্তানি কর নেওয়া হয়। কিন্তু চলতি মাস থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী এই করের হার বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ২৫.৫ শতাংশ। এর ফলে অন্যান্য ভারতীয় পণ্যের সঙ্গে মাখনার দাম আমেরিকায় অনেকটাই বেড়ে যাবে। আর তাতেই এই সুপার ফুডের রপ্তানিতে বড় ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। রপ্তানিতে কোপ পড়লে লোকসানের মুখে পড়বেন ভারতের বিহার এবং মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুরের মাখনা ব্যবসায়ী এবং কৃষকরা।
জেলা ব্যবসায়ী মহল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর থানা সহ বেশ কয়েকটি ব্লকে প্রায় ২৩ হাজার ৫০০ একর জমিতে মাখনা চাষ হয়েছে। লাভের পরিমাণ বেশি থাকায় ধান চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে কৃষকরা মাখনার দিকে ঝুঁকছেন। অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এবার চাষ করেছেন। জেলা শিল্প মহল সূত্রেই জানা গিয়েছে, গত আর্থিক বছরে মাখনাকে কেন্দ্র করে প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা টার্নওভার হয়েছিল। এবার সেই অঙ্ক অনেকটাই কমবে বলে আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ী মহল।
এলাকার মাখনা ব্যবসায়ী বসন্ত কেডিয়া বলেন, ‘প্রতিবছর হরিশ্চন্দ্রপুর এলাকা থেকে প্রায় ১০ লক্ষ বস্তা মাখনার খই ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। তার মধ্যে আমেরিকাও রয়েছে। ভারতবর্ষের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ মাখনা বিহার থেকে রপ্তানি হয়। বাকি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মাখনা মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর সরবরাহ করে। গত বছর ভারত থেকে ৬০০ টন মাখনা আমেরিকায় গিয়েছিল। আমেরিকার এই শুল্ক ঘোষণার পর আমরা আশঙ্কায় রয়েছি রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়বে। এদিকে, এবছর উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মাখনার দাম কমে যাবে।’
গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে সরাসরি মাখনা রপ্তানি করেছেন এলাকার ব্যবসায়ী তনুজ জৈন। তিনি বলেন, ‘আমি গতবছর মুম্বই বন্দর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস, ওহিও, নিউ ইয়র্ক সিটি সহ একাধিক জায়গায় মাখনা রপ্তানি করেছি। তবে ভারতবর্ষেও এর বিশাল বাজার রয়েছে। অন্যান্য দেশেও চাহিদা প্রচুর। যদি এই নতুন ট্যাক্স পরিকাঠামোর ফলে মার্কিন নাগরিকরা আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন তবুও আমাদের কাছে বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে।’
পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ড এবং বিহারের বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে প্রতি বছর হরিশ্চন্দ্রপুরে কর্মসংস্থানের জন্য ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক আসেন। তাঁরা সবাই পরিবার নিয়ে এই মাখনা বীজ থেকে খই প্রস্তুত করেন। পাশাপাশি হরিশ্চন্দ্রপুর এলাকায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার কৃষক সরাসরি তাঁদের জমিতে এখন ধান এবং অন্যান্য ফসলের পরিবর্তে মাখনা চাষে জোর দিয়েছেন। এ বছর রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হওয়ার আশা রয়েছে। এই মুহূর্তে রপ্তানিতে প্রভাব পড়লে বাইরের রাজ্যের শ্রমিকদের যেমন কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে সেরকমই কৃষকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ী মহলের।
হরিশ্চন্দ্রপুর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডাবলু রজক বলেন, ‘এলাকায় মাখনাশিল্পকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে আমরা বিভিন্ন সময়ে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছি। আমরা চেষ্টা করব প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে বিহারের মতো এখানেও যাতে মাখনা বোর্ড তৈরি করা যায়। তাতে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।’