রামপ্রসাদ মোদক, প্রয়াগরাজ: মঙ্গলবার রাতের দুঃস্বপ্নের ঘোরটা এখনও কাটেনি। থেকে থেকে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ‘ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট’ এই কথাটা কাগজে বহুবার পড়েছি। চোখের সামনে দেখার অভিজ্ঞতা যে এতটা ভয়ংকর, আমার এত বছরের সাংবাদিক জীবনে তা বুঝতে পারিনি।
কুম্ভমেলা (Maha Kumbh 2025) আমার কাছে নতুন নয়। এর আগে একাধিকবার কুম্ভে গিয়েছি। কিন্তু এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন কখনও হইনি। আমার গুরুদেব স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী পরমহংসদেবের প্রতিটি কুম্ভ মেলায় শিবির হয়। এবার প্রয়াগরাজ মহাকুম্ভেও সেক্টর ১৭ হর্ষবর্ধন মার্গ ও হরিশ্চন্দ্র মার্গে শিবির হয়েছে কোকিলামুখ মঠ এবং হালিশহর মঠের পক্ষ থেকে। দুই শিবিরে প্রায় ২ হাজার ভক্তর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।
সন্ধ্যায় পূজা আরতির পর ঘোষণা করা হয়, রাত সাড়ে দশটায় ঠাকুর মহারাজের প্রতিকৃতি সহ ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করতে যাওয়া হবে। প্রায় ৮০০ মহিলা-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, এমনকী শিশুদের নিয়ে রাত পৌনে এগারোটায় শোভাযাত্রা বের হয়। নাগবাসুকি চৌরা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাঁ-দিকে ঘুরে শংকরাচার্য মার্গ দিয়ে সঙ্গমের দিকে মিছিল করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ত্রিবেণী সঙ্গমের কিছুটা আগে পুলিশ ব্যারিকেড করে আমাদের শোভাযাত্রা আটকে দেয়। পুলিশ শোভাযাত্রা বাঁ-দিকে অনেকটা দূর দিয়ে ঘুরিয়ে দিতেই শুরু হয় বিপত্তি। বেশ কিছু গাড়ি ওই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকায় প্রচণ্ড একটি ভিড় ঠেলে কোনওরকমে সঙ্গমে পৌঁছাই রাত ১ টার দিকে।
রাত ২ োটা নাগাদ স্নান সেরে ফিরে আসার পথে চরম বিপর্যয় ঘটে গেল। ত্রিবেণী সঙ্গমে তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের মেলা। বেশকিছু মানুষ দলছুট হয়ে গিয়েছেন ভিড়ের মধ্যে। কিলোমিটার খানেক এগিয়ে এলাম ভিড়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে। প্রথম চৌরা পার হয়ে দ্বিতীয় চৌরায় ঢুকে দেখি পুলিশ সেখানে ব্যারিকেড করে রাস্তার একটি পাশ ছোট করে দিয়েছে। অন্যদিক থেকে একটি গাড়ি ঢোকায় রাস্তা অনেকটা ছোট হয়ে গিয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠল। সামনে তখন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে। পিছন থেকে হাজার হাজার লোক ধাক্কা মারছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল একদল মানুষ। সেটা সামাল দিতে না দিতেই পাশের থেকে আর্তনাদ ‘বাচাঁও, বাঁচাও’। চোখের সামনে প্রচণ্ড ধাক্কায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এক বৃদ্ধা। তাঁকে তুলতে চাইলেন কয়েকজন। কিন্তু সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো তাঁদের ঠেলে কয়েক হাজার মানুষ চলে গেল বৃদ্ধার উপর দিয়ে। একটু পরেই শুনি ভাইয়ের ছেলের চিৎকার, ‘বাবা বাঁচাও।’ ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল। দেখি ভাই পিঠু ব্যাগ ফেলে ছেলেকে আগলাচ্ছে। একটু এগোতেই বন্যার জলের মতো ব্যারিকেড টপকে ভেসে এল হাজার হাজার লোক। কপাল ভালো পাশ ঘেঁষে চলে গেল ওরা।
কীভাবে যেন ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে দ্বিতীয় চৌরা পার হয়ে এলাম। আমার পরিবারের সবাই ঠিক আছে। শিবিরে এক মহিলা বাদে সবার খোঁজ মিলেছে। পুলিশ (Police) ব্যরিকেড দিয়ে অনেকগুলো ঘাট বন্ধ করে দেওয়াতেই সঙ্গমের পরিস্থিতিটা এমন হল। অনেক রাত ঘুমোতে পারব না মহাকুম্ভের কথাটা মনে পড়লে।