লন্ডন, ২৬ জুলাই : স্বাস্থ্য (Well being) ভালো রাখতে হাঁটার যে কোনও বিকল্প নেই, এ কথা কে না জানে! কিন্তু দিনে কতটা ও কীভাবে হাঁটলে সুস্বাস্থ্য ধরে রাখা যায়, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, ১০ হাজার। কেউ আবার বলেন, আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী!
কিন্তু নতুন এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন ৭ হাজার পা হাঁটলেই (Strolling) ডিমেনশিয়া, অবসাদ, হার্টের সমস্যা এমনকি ক্যানসারে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটা কমানো যায়। চালু ধারণা অনুযায়ী, অনেকেই প্রতিদিন ১০ হাজার পা হাঁটার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যস্ত জীবনে সেটা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। এই পরিস্থিতিতে নতুন গবেষণার (Analysis) ফল ব্যস্ত মানুষদের নিশ্চয়ই খুশি করবে।
গবেষকরা বলছেন, দিনে ১০ মিনিট হাঁটলেও লাভ। কিন্তু কত দূর হাঁটলে কী পরিমাণ স্বাস্থ্যোন্নতি হয়, তার একটা তুলনামূলক ছবিও দিয়েছেন তাঁরা। ১ লক্ষ ৬০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, যাঁরা দিনে ২ হাজার পা হাঁটেন, তাঁদের তুলনায় যাঁরা ৭ হাজার পা হাঁটেন, তাঁদের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি ৬ শতাংশ ও মৃত্যুর ঝুঁকি ৩৭ শতাংশ কমে যায়। একই সঙ্গে তাঁদের টাইপ-২ ডায়াবিটিসের ঝুঁকি ১৪ শতাংশ, ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ)-র ঝুঁকি ৩৮ শতাংশ আর অবসাদের ঝুঁকি ২২ শতাংশ কমে যায়। এছাড়া তাঁদের হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ২৮ শতাংশ, হৃদরোগের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ এবং সাধারণ মৃত্যুহার ৪৭ শতাংশ কমে।
এই নতুন গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পত্রিকা ‘ল্যানসেট পাবলিক হেলথ জার্নাল’-এ (Lancet Public Well being Journal)। সেখানে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিদিনের হাঁটাহাঁটি যত বাড়বে, রোগের ঝুঁকি তত কমবে। তবে ৭ হাজার পা পেরিয়ে গেলে ঝুঁকি কমার হার কিছুটা শ্লথ হয়ে যায়।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক তথা সমীক্ষক দলের প্রধান মেলোডি ডিং বলেন, যাঁরা ইতিমধ্যে প্রতিদিন ১০ হাজার পা হাঁটা রপ্ত করে ফেলেছেন, তাঁদের লক্ষ্য কমানোর দরকার নেই। তবে যাঁরা একেবারে নিষ্ক্রিয়, তাঁদের জন্য ৭ হাজার পা-ই যথেষ্ট। এতে উপকারের হেরফের হবে না!
ডিংয়ের সঙ্গে সহমত বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল বেইলি। ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘আমাদের গবেষণায় প্রমাণ হচ্ছে, স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ১০ হাজার পা হাঁটার কোনও প্রয়োজন নেই। বরং দিনে ৫-৭ হাজার পদক্ষেপই অনেকের পক্ষে সহজ এবং কার্যকর। এই দূরত্ব হাঁটলে উপকার বরং বেশিই হয়।’ তাঁর মতে, ‘হাঁটা যেমন শরীরের জন্য ভালো, তেমনই বেশি হাঁটাও কিন্তু ক্ষতিকর। কার কতটা হাঁটা উচিত, সেটা তাঁর শরীরের ওজনের ওপর নির্ভর করে।’
পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যান্ড্রু স্কট মনে করিয়ে দিলেন, ‘সাইক্লিং, সাঁতার বা নৌকাবাইচ-এর মতো ব্যায়াম কিন্তু হাঁটার মধ্যে ধরা যায় না। সেগুলিতে উপকার নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু সাইকেল, সাঁতার বা রোয়িং— কোনওটাতেই শরীরের ওজন মাটিতে পড়ে না বলে মাপা কঠিন।’
ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের সিনিয়ার নার্স জুন ডেভিসন বলেন, ‘হাঁটাহাঁটি সহজ একটি উপায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার শরীরচর্চা করতে হবে। ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটা বা লাঞ্চ ব্রেকে ১০ মিনিট দ্রুত হাঁটাও এর মধ্যে পড়ে।’ তাঁর কথায়, ‘তবে ‘কদম কদম বাড়ায়ে যা’ ছন্দে হাঁটলে হবে না। হাঁটতে হবে জোরে, এমনভাবে, যাতে ১০ মিনিটের মধ্যেই ঘাম ঝরে!’
শেষে একটি মিথ ভাঙা যাক। ১০ হাজার পা হাঁটলে তবে উপকার, এই ধারণাটা এল কোথা থেকে? আসলে ১৯৬৪ সালের টোকিও অলিম্পিকের আগে জাপানে এক ধরনের ‘পেডোমিটার’ বা ‘পদক্ষেপ-গণনা যন্ত্র’ বাজারে এসেছিল। তার নাম ‘মানপো-কেই’, অর্থ ‘১০ হাজার পা মাপার মিটার’! সেখান থেকেই এই ‘১০ হাজার পা’ ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। মেলোডি ডিং বলছেন, ‘১০ হাজার পা’র কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটা বিজ্ঞাপনের চমক ছাড়া কিছু নয়!’