সপ্তর্ষি সরকার, ওদলাবাড়ি: কথায় বলে ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’ সময় বদলায়, দিন বদলায়, বদলে যায় চারপাশের লেনদেন। কিন্তু সেই বদল সহজে সবাই মেনে নিতে পারে না। সেই নাছোড় মনোভাব থেকেই শুরু হয় টিকে থাকার মরিয়া লড়াই। রোজগারের সেই মরণকামড়েই বাড়ে উত্তেজনা। বালি-পাথর-বোল্ডার মাফিয়াদের মারমুখী হয়ে ওঠার পিছনে ব্যবসায় মন্দাই বড় কারণ।
প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে বহাল তবিয়তে ফুলেফেঁপে উঠেছিল যে কারবার তাতে প্রথম আঘাত আসে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্যে ‘সুবিধা’ পোর্টালের মাধ্যমে স্লট বুকিং সিস্টেমে৷ নতুন সিস্টেমে যাতায়াতে সুবিধা হচ্ছে বলে রাজ্য প্রশাসন দাবি করলেও এতে একলপ্তে নেমে যায় বর্ডারের ওপারে যাতায়াত। এক সময় যেখানে গড়ে প্রতিটি গাড়ি সপ্তাহে অন্তত এক ট্রিপ বালি-পাথর বাংলাদেশে পাঠাতে পারত সেখানে এটাই গড়ে মাসে এক ট্রিপ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে কারবারিদের পক্ষে। মূলত এই কারণেই একসময় কোচবিহার জেলার চ্যাংরাবান্ধা, জলপাইগুড়ি জেলার ফুলবাড়ি সীমান্ত এলাকা এবং বালি-পাথরের কারবারের হাব হয়ে ওঠা জলপাইগুড়ির (Jalpaiguri) ওদলাবাড়ি ও মালবাজার এলাকায় ডাম্পার কেনার হিড়িক পড়লেও এখন সেখানে অনেকেই গাড়ি বেচে মুক্তি পেয়েছেন। ওদলাবাড়ির এক তরুণ কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, চার বন্ধু মিলে ধার করে ছয় লাখ করে জুটিয়ে ২৪ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দুটি বারো চাকার ডাম্পার কিনেছিলাম। বছর খানেকের মধ্যে কারবারে এমন মন্দা এল যে মাত্র ১৪ লাখ টাকায় দুটো গাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। এখনও সেই ঋণ শোধ করে যাচ্ছি।
এই কারবারের শিড়দাঁড়ায় শেষ আঘাতটা আসে গতবছর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে৷ এদেশের বদলে ভুটান থেকে বেশি বালি-পাথর কেনা শুরু করে বাংলাদেশের আমদানিকারীরা। তাছাড়া ভুটান রেজিস্ট্রেশনের গাড়িতে এ দেশের স্লট বুকিং সহ অন্যান্য খরচ না থাকায় বালি-পাথরের দামও কম পড়ে। ভারতের থেকে সস্তায় বাংলাদেশে সরাসরি বালি-পাথর বিক্রি করছে ভুটানের কারবারিরা। দু’দেশের কারবারের অছিলায় বাংলাদেশের উদ্দেশে ভুটান থেকে রওনা হওয়া সামগ্রী নামিয়ে নেওয়া হচ্ছে ভারতে। ফলে বালি-পাথরের স্থানীয় ও বিদেশি বাজার অনেকটা কমেছে গত এক-দুই বছরে৷
লোকসানের বহর কমাতে শুরু হয় ওভারলোডের বেআইনি কারবার। ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বা তার বেশি বালি-পাথর লরি বা ডাম্পারে তুলে বাজারে টিকে থাকার এই মরিয়া লড়াই বাড়িয়েছে পথের খরচ। ওভারলোড গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কারবারে নজরানা দিতে হয় নেহাত কম নয়। ওদলাবাড়ি থেকে মালবাজার-ময়নাগুড়ি-মেখলিগঞ্জ রুট, গজলডোবা-ফুলবাড়ি রুট, ক্রান্তি-ময়নাগুড়ি-মেখলিগঞ্জ রুটে সবেতেই তীক্ষ্ণ নজর থাকে পুলিশ ও পরিবহণ দপ্তরের। লাইন চালু রাখতে মাসে গাড়ি প্রতি গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা নজরানা পৌঁছাতে হয় ডাম্পার মালিকদের। এর ওপর আছে টোলের খরচ। ওভারলোড ডাম্পার টোল পাড় করতে গড়ে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা খরচ পড়ে প্রতি ট্রিপে। এক ডাম্পার মালিকের কথায়, ২০২২ সালেও গোটা জেলায় লাইন চালাতে গাড়ি প্রতি মাসে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ পড়ত, যা এখন তিন-চারগুণ বেড়েছে। ফলে ওভারলোড না চললে এই কারবারই টিকবে না।
বড় বাজার খুইয়ে আপাতত এই কারবারের মূল লক্ষ্য স্থানীয় নির্মাণ শিল্পের বাজার। সেজন্য আগের তুলনায় বালি-পাথর কারবারিদের এই মুহূর্তে নজর শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ধূপগুড়ি সহ প্রতিবেশী রাজ্য বিহারেও। সেখানেও ভুটানের থাবা আছে। এই কারণে প্রতিনিয়ত কারবারে বাড়ছে আকচাআকচি। ফলে তেতে রয়েছে কারবারে যুক্ত লোকেরা। ওদলাবড়িতে ঘিস নদীর বেডে দাঁড়িয়ে এক কারবারি গলায় কিছুটা দার্শনিক সুর, চা বাগানের অবস্থা ভালো নয়। ফরেস্টকে কেন্দ্র করে যে রিসর্ট বা হোমস্টে ব্যবসা তার প্রায় পুরোটাই দক্ষিণবঙ্গের মালিকদের হাতে৷ এই অবস্থায় গরিব, আদিবাসী, সংখ্যালঘু প্রান্তিক মানুষ কী করে খাবে। এই জন্যেই নদীবেডে নজর সবার। আমাদের দেওয়া টাকায় কোনও দোষ নেই। সমস্যা শুধু আমাদের নিয়ে৷
ফি বর্ষায় পাহাড় থেকে ভাসিয়ে আনা বালি-বজরি-পাথরে ভরে ওঠে লিস-ঘিস-চেলের বুক৷ পেটের দায়ে সেই বুকে হানা দেয় চুনোপুঁটি থেকে রাঘববোয়াল৷ কোটি কোটি টাকার কারবারে চলে ভাগাভাগির খেলা।
The publish Jalpaiguri | বাজারে মন্দা, তাই মারমুখী কারবারিরা appeared first on Uttarbanga Sambad.