রাহুল মজুমদার, শিলিগুড়ি : রোদ-বৃষ্টিতে মুছেছে রক্তের দাগ। দু-একটি চাকা ইতিউতি ছড়িয়ে থাকলেও কালের নিয়মে আবছা হয়েছে গত বছরের ভয়ংকর ট্রেন দুর্ঘটনার স্মৃতি। কুণ্ডলী পাকানো দেহগুলি যেখানে পড়েছিল, সেখানে এখন সবুজ ঘাস হাওয়ায় খেলে বেড়াচ্ছে। পাশ দিয়ে একটু পরপরই ছুটে চলেছে রেলগাড়ি। যাত্রীদের কেউ আর সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না।
দিনটা ছিল ১৭ জুন, ২০২৪। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় শিরোনামে উঠে এসেছিল রাঙ্গাপানির ছোট নির্মলজোতের নাম। অখ্যাত এই গ্রামে ছুটে এসেছিলেন খোদ রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণো। দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে কাঁটাছেড়াও হয়েছিল বেশ। কমিশনার অফ রেলওয়ে সেফটি (সিআরএস)-এর রিপোর্টে উঠে এসেছিল রেলের একাধিক গাফিলতির কথা। সেইসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছিল পরিকাঠামোর অভাবও। যাত্রীসুরক্ষা নিশ্চিত করতে কী কী পদক্ষেপ প্রয়োজন তা সেই রিপোর্টের পরতে-পরতে তুলে ধরা হলেও ছবিটা কিন্তু বদলায়নি এতটুকু। বরং সেই দুর্ঘটনার বর্ষপূর্তিতে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলেই তুলে ধরছেন রেলকর্মীরা।
গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বড় দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে ভারতীয় রেল। রাঙ্গাপানির দুর্ঘটনা তার মধ্যে একটি। এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল রেলের সিগন্যালিং ব্যবস্থায় বড় গলদের কথা। সিআরএসের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ২০ জুন পর্যন্ত কাটিহার ডিভিশনে ২৭৫ বার স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছিল। এই ধারা এখনও বজায় রয়েছে বলেই জানাচ্ছেন রেলকর্মীরা। যদিও তা মানতে নারাজ উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কপিঞ্জলকিশোর শর্মা। তিনি বলছেন, ‘রেলকর্মীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ওয়াকি-টকি দেওয়া হচ্ছে। কবচ সিস্টেম চালু করার জন্য আর্থিক বরাদ্দও হয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।’
বাস্তব অবশ্য বলছে অন্য কথা। রেল সূত্রেই খবর, গত এক বছরে কাটিহার ডিভিশনেই অন্তত ৫০ বার স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। আলিপুরদুয়ার ডিভিশনেও এমন ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। কাটিহার ডিভিশনের কাটিহার স্টেশনে ২৬০টি ওয়াকি-টকি থাকার কথা। কিন্তু ২০২৪ সালে সেটা ছিল মাত্র ৭২টি। দুর্ঘটনার পর ওয়াকি-টকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন সিআরএস। তারপর সংখ্যাটা ৭২ থেকে ১০০-এর কাছাকাছি হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম। অন্যদিকে, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ৩৭৭টি ওয়াকি-টকির প্রয়োজন হলেও ২০২৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ছিল মাত্র ১৬৯টি। দুর্ঘটনার পর মাত্র এক জোড়া ওয়াকি-টকি বাড়ানো হয়েছে।
যেদিন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেদিন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ১৮টি মালগাড়ি রওনা হয়েছিল বিভিন্ন গন্তব্যে। ওই মালগাড়িগুলির কোনও ক্রু’র কাছেই ওয়াকি-টকি ছিল না। রেলকর্মীরাই জানাচ্ছেন, বর্তমানে যা পরিস্থিতি তাতে এখনও একাধিক ট্রেনের ক্রুদের ওয়াকি-টকি দেওয়া হয় না। রেলের দেওয়া সিইউজি সিম ব্যবহার করেই কাজ চালাতে হচ্ছে লোকোপাইলট এবং ট্রেন ম্যানেজারদের।
দুর্ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যুর খবর পেয়ে সেদিন নির্মলজোতে ছুটে গিয়েছিলেন মেডিকেল মোড়ের বাসিন্দা রতন রায়। পেশায় গাড়িচালক রতন বলছেন, ‘খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম, লাশগুলো কীভাবে টেনেহিঁচড়ে বের করা হচ্ছিল। অথচ সেই মানুষগুলো কি কখনও ভেবেছিলেন, সেটাই তাঁদের শেষযাত্রা হবে? না, আমরা কেউই সেটা ভাবি না। কিন্তু রেল যেভাবে চলছে বলে শুনছি, তাতে এরপর নিশ্চিত ভয় হবে ট্রেনে উঠতে। এত টাকা দিয়ে টিকিট কেটে এটাই কি আমাদের প্রাপ্য?’
রাঙ্গাপানির সেই দুর্ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রথমে মালগাড়ির লোকোপাইলট এবং সহকারী লোকোপাইলটকে দোষী সাব্যস্ত করে দিয়েছিল ভারতীয় রেল বোর্ড। কিন্তু মাসখানেক বাদে সিআরএস ৫২ পাতার যে রিপোর্ট পেশ করেন, সেখানে রেলের পরিকাঠামোর খামতির কথাই তুলে ধরা হয়। উত্তরবঙ্গ সংবাদ অবশ্য তার আগেই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে একাধিক বিষয় তুলে ধরেছিল। সব থেকে বড় গাফিলতি ছিল স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থার প্রশিক্ষণে। এই ব্যবস্থায় কী করে ট্রেন চালাতে হয়, চালকদের ৯০ শতাংশই এখনও তা জানেন না। অভিযোগ, যাঁরা অন্য ডিভিশন থেকে এসেছেন সেরকম হাতেগোনা কয়েকজন চালক ছাড়া কাটিহার ডিভিশনের অন্য চালকদের স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালে ট্রেন চালানো কিংবা বিফল হলে কী করতে হবে সেই সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নেই।
আলিপুরদুয়ারে রেলের যে প্রশিক্ষণ স্কুল রয়েছে, সেখানে হাতেকলমে এসব শেখানোর কথা ছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কোনও প্রশিক্ষণ হয়নি বলেই দাবি লোকোপাইলটদের একাংশের।
এখানেই শেষ নয়। এক বছর আগেই সিআরএস কবচ প্রযুক্তি চালু করার কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এখনও কাটিহার ডিভিশনে কবচ প্রযুক্তি চালুই করা যায়নি। আর এতেই প্রশ্ন উঠছে যাত্রীসুরক্ষা নিশ্চিত করতে রেলের সদিচ্ছা নিয়ে।
সুকান্তপল্লির বাসিন্দা অভিষেক বসাকের কথায়, ‘কোচবিহারে চাকরিসূত্রে নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়। গত কয়েক বছরে এত ট্রেন দুর্ঘটনা দেখেছি ও শুনেছি, যাতে সবসময় একটা ভয় তো কাজ করেই। রেল আসলে কোনওদিনই সেভাবে যাত্রীসুরক্ষার কথা ভাবেনি।’ একই মন্তব্য লেকটাউনের অনীতা বৈদ্যের। তিনি বলছেন, ‘আমার এক প্রতিবেশী চোখের সামনে মৃত্যু দেখে এসেছেন। সেই ঘটনার এক বছর পরও ন্যূনতম পরিবর্তন হয়নি। এটা অত্যন্ত হাতাশার। ভারতীয় রেলের কর্তাদের কাছে আমাদের আর্জি থাকবে, এবার অন্তত চোখ খুলুন।’
অনীতাদের দাবি মেনে রেলকর্তারা আদৌ চোখ খুলবেন কি না, সেটা অবশ্য সময়ই বলবে।