শুভঙ্কর চক্রবর্তী, হলদিবাড়ি: কপালে তিলকের মাঝে লাল রংয়ের ত্রিশূলের ছাপ, সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখাপলা, পরনে সাধারণ ছাপা শাড়ি। ডান হাতে মোমবাতি, ধূপকাঠি আর নকুলদানার প্যাকেট। বাঁ হাতে ধরা ছেলের হাত। ভিড় ঠেলে গৃহবধূ হাঁটু গেড়ে বসলেন মাজারের সামনে। মোমবাতি, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দুই হাত মুখের সামনে এনে প্রার্থনা করলেন। তারপর মোমবাতির উপর হাত রেখে পরশমণি ছোঁয়ালেন শিশুটির মাথায়। মায়ের নির্দেশে শিশুটিও হাতে থাকা লাল গোলাপ দুটি মাজারের কাছে রেখে প্রণাম করলেন। ধর্ম নিয়ে গেল গেল রব তুলে যখন রাজনীতির কারবারিরা ফায়দা তুলতে ব্যস্ত তখন হলদিবাড়ির (Haldibari) হুজুর সাহেবের মেলায় (Huzur Saheb Mela) বুধবারের এই ছবি অন্ধকারে আলোর দিশা দেখাচ্ছে।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’- এই এক লাইনেই সেই কবে কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বুঝিয়েছিলেন অন্ন নির্ভরতাই আসল সত্য। অন্ন ও মানুষের সম্পর্কের মধ্য দিয়েই দেবত্বের সৃষ্টি। সেই দেব কোথাও রামচন্দ্র, কোথাও হুজুর সাহেব। মহাকুম্ভের সংগমে ডুব দিয়ে কেউ সন্তানের দুধভাতের নিশ্চয়তা খোঁজেন, কেউ তা খুঁজে পান হলদিবাড়ির মাজারে ধূপ জ্বালিয়ে। হুজুরের দরগায় প্রার্থনা শেষে সেই সুর শোনা গেল আলিপুরদুয়ারের বারবিশার মৌসুমি রায়ের গলায়। তাঁর কথা, ‘ছেলেটার অসুখ লেগেই আছে। সে যেন সুস্থ থাকে তার জন্যই পিরবাবার কাছে প্রার্থনা করলাম।’ হিন্দু হয়ে দরগায় মাথা ঠেকাতে মনে দ্বিধা হল না? মৌসুমির উত্তর, ‘মনে পাপ না থাকলেই হল। আমাদের বাড়িতে কালীপুজোর প্রায় সব কাজই তো বাবার বন্ধু আমজাদ কাকা করেন। বাবা-মা তো কোনওদিন কিছু বলেননি। এখন ওইসব হিন্দু-মুসলিম কেউ মানে না।’
গত দু’দিনে হাজার হাজার মৌসুমিরা হুজুর সাহেবের দরগায় মাথা ঠেকিয়েছেন, মানত করেছেন। মহাকুম্ভ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কলকাতা থেকে উত্তরপ্রদেশ তোলপাড় চলছে। দরগা থেকে খানিক দূরেই বাংলাদেশ সীমান্ত। কাঁটাতারের ওপারের ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ হচ্ছে। বাইরের জাতপাতের লড়াইয়ে যে সাধারণ মানুষ নেই তা হুজুরের মেলায় ঘুরলেই স্পষ্ট হবে।
অযোধ্যা থেকে মেলায় এসেছেন ফকির মহম্মদ চাঁদ হুসেন। ভক্তদের আর্শীবাদ দেওয়ার পাশাপাশি মন্ত্রপূত তাবিজও বিক্রি করছিলেন তিনি। তাঁর পাশেই গেরুয়া বসন পরে ভক্তদের কপালে তিলক কাটছিলেন নবদ্বীপের গোপাল বৈরাগ্য। একহাতে ছোট্ট পিতলের সিংহাসনে রাধাকৃষ্ণর মূর্তি এবং অন্য হাতে তিলকের বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে হরেকৃষ্ণ-হরেকৃষ্ণ করে গুনগুন করছিলেন। চাঁদ হুসেনের কথা, ‘সব ধর্মই তো এক। আমাদের ডাকার পদ্ধতি আলাদা। অন্য ধর্মকে অসম্মান করার অর্থ নিজের ধর্মকে অসম্মান করা। আমিও তো রাম মন্দিরে গিয়ে প্রসাদ খেয়েছি।’ গোপালের বক্তব্য, ‘ধর্ম মানে তো ভালোবাসা, হিংসা নয়। সবাই প্রকৃত ধর্ম মেনে চললে শুধুই ভালোবাসা থাকত। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে।’
পান্ডুয়া শরিফের মোস্তাক ফকির, ইসলামপুরের ফকির হজরত আলির সঙ্গে মেলায় ঘুরে ঘুরে নিজেদের ধর্মাচরণ করছেন শিলিগুড়ির প্রফুল্ল মহন্ত, কালিয়াগঞ্জের নমিতা দাসীরা। কোথাও কোনও প্রতিযোগিতা নেই, হিংসা নেই। হুজুরের মেলার এক্রামিয়া ইসালে সওয়াব কমিটির সম্পাদক লুৎফর রহমানের কথা, ‘ফকির আর বৈরাগীর এই সহাবস্থানের কথাই তো যুগে যুগে মহাপুরুষরা বলেছেন। ভেদাভেদ নয়, শুধুই ভালোবাসা ছড়াক। আমরা সেই বার্তাই দিতে চাই। তাই মোমবাতির সঙ্গে মাজারে ভালোবাসার প্রতীক লাল গোলাপ দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রূপ বদল করে চলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধন হয়তো কখনোই পুরোপুরি আলগা হবে না। কিন্তু চারপাশের ধর্মীয় অনৈক্যের মাঝে হুজুরের মেলা মনুষ্যত্ব ও বিবেককে সজাগ রাখার বার্তা বহন করে চলছে।