শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: ২০১৭ সালের পর রাজ্যে কলেজগুলিতে ছাত্র নির্বাচন হয়নি (Faculty Pupil Union)। ফলে আইনত কোথাও ছাত্রছাত্রী সংসদের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু গত আট বছরে কলেজে কলেজে সংসদ অফিসের দখল চলে গিয়েছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের হাতে। বকলমে সেই ‘ইউনিয়ন রুম’ থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে কলেজের ভর্তি থেকে সোশ্যাল বা নবীনবরণ থেকে বার্ষিক ক্রীড়া সবকিছুই। কসবার আইন কলেজের ম্যাঙ্গো’র মতো উত্তরবঙ্গের কলেজগুলিতেও দাদাগিরি চালাচ্ছেন মার্ডার বা ডিস্কো’র মতো টিএমসিপি নেতারা। কারও পাঁচ বছর আগে, কারও সাত বছর আগে ছাত্রজীবনে ইতি পড়েছে। তবুও কলেজের মধুর ভাণ্ডারের লোভ ছাড়তে পারেনি কেউই। কসবা কাণ্ডের পর কলেজে কলেজে প্রাক্তনদের দাদাগিরি আদৌ বন্ধ হবে কি না তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।
টিএমসিপি’র রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর কথা, ‘আমাদের সংগঠনের ছেলেরা কলেজে ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থেই কাজ করে। কোথাও সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে কেউ ব্যক্তিগত স্তরে অপকর্ম করলে তার দায় সংগঠনের নয়।’ তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য, ‘কেউ অন্যায় করলে আইন অনুসারে তার বিচার হবে। দল কোনও অন্যায়ের পাশে দাঁড়াবে না।’ তৃণমূল নেতারা বলছেন ঠিকই, তবে একের পর এক ঘটনায় তাঁদের ভূমিকা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
তাঁদের ডাকা মিছিলে যেতে না চাওয়ার অপরাধে ১৩ জন ছাত্রীকে গার্লস কমনরুমের শৌচাগারে আটকে রেখে শাস্তি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল দিনহাটা কলেজের টিএমসিপি দাদাদের বিরুদ্ধে। ২০২৪ সালের ৩০ অগাস্টের সেই ঘটনার পরও কলেজে দাদাগিরি কমেনি টিএমসিপি’র। গত এক বছরে কলেজে বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য ক্রমেই বেড়েছে। টিএমসিপি’র দুই গোষ্ঠীর কোন্দলেও বারেবারে রক্তাক্ত হয়েছে ক্যাম্পাস। পরীক্ষায় নকল সরবরাহে বাধা দেওয়ায় হেনস্তার মুখে পড়তে হয়েছে শিক্ষকদের। বহিরাগতদের ‘অত্যাচার’ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, খোদ কলেজের অধ্যক্ষের নেতৃত্বে রাজ্য সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে বাধ্য হন কলেজের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা। দিনহাটা কলেজের পরিচালন কমিটির সভাপতি উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী উদয়ন গুহ। আর কসবা মডেলে সেই কলেজেই আইন ভেঙে একগুচ্ছ তৃণমূল নেতাকে অস্থায়ী কর্মী হিসাবে চাকরিতে নিয়োগ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আবার নির্দেশ আসে ক্যান্টিন থেকে। সেখানেই বসেই কলেজের এক প্রাক্তন ছাত্র বকলমে সব ঠিক করে দেন। তাঁর কথার বাইরে গিয়ে কোনও কাজ করলেই জোটে চরম শাস্তি। ভর্তির জন্য ছাত্রপিছু কত টাকা চাঁদা নেওয়া হবে, সোশ্যালে কোন গায়ক গান করবেন সবই হয় সেই ক্যান্টিনবয়ের ইচ্ছে অনুসারে। ইসলামপুর কলেজের ইউনিয়ন রুমের দখল নিয়ে টিএমসিপি’র দুই গোষ্ঠীর লড়াই সর্বজনবিদিত। কলেজের হর্তাকর্তা হয়ে বসে রয়েছেন বিধায়ক আবদুল করিম চৌধুরীর ছোট ছেলে ইমদাদ চৌধুরী। বছর বত্রিশের ওই তরুণের কলেজ পরিচালন কমিটির সভাপতি পদে বসা নিয়ে বিতর্ক এখনও পিছু ছাড়েনি।
শিলিগুড়িতে প্রতিটি কলেজেই নিয়ন্ত্রণ করছে বহিরাগতরাই। শিলিগুড়ি কলেজ এবং শিলিগুড়ি কর্মাস কলেজের ক্ষমতা দখল নিয়ে টিএমসিপি’র দুই গোষ্ঠীর লড়াইয়ে কিছুদিন আগে মাঝরাতে ঘেরাও হয় মেয়র গৌতম দেবের বাড়ি। মার্ডার গোষ্ঠীর সঙ্গে পচা গোষ্ঠীর মারামারিতে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল শহরের তৃণমূল নেতাদের। জলপাইগুড়ির কলেজগুলিতে কান পাতলেই শোনা যায় ডিস্কোদা’র নাম। ডিস্কো আদতে টিএমসিপি নেতা দেবজিৎ সরকার। তৃণমূল নেতা সৈকত চট্টোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ ডিস্কোর ইশারা ছাড়া নাকি কলেজে কোনও কাজই হয় না।
কলেজে কলেজে বহিরাগত এই সিন্ডিকেট ভাঙার জোরালো দাবি তুলেছে সিপিএম এবং বিজেপি। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথা, ‘নির্বাচন না করিয়ে তৃণমূল গুন্ডারা কলেজের ইউনিয়ন রুমগুলিকে পার্টি অফিস বানিয়ে ফেলেছে। সেখান থেকেই যাবতীয় অন্যায় ও অপকর্ম হচ্ছে। ভোটে ওই দুষ্কৃতকারীরাই শাসকদলের ক্যাডার হয়ে মাঠে নামছে। দ্রুত ছাত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক রাজ্য সরকার।’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, ‘ছাত্র নির্বাচন বন্ধ করে রেখে কলেজে কলেজে গুন্ডা পুষছে তৃণমূল। বেআইনি পথে লক্ষ লক্ষ টাকা সেই গুন্ডাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের অপকর্ম করার ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছে।’