বর্ষীয়ান পরিচালক প্রভাত রায়ের জন্মদিন শুক্রবার। এখনও সিনেমা শুরুর স্বপ্ন দেখেন। জীবন, ইন্ডাস্ট্রি, আক্ষেপ সব কিছু নিয়ে অকপট আট-নয়ের দশকের ‘হিটমেকার’। শুনলেন শম্পালী মৌলিক
‘৮১ অ্যান্ড রোলিং’ ভাবতে কেমন লাগে?
– ৮১-তে পড়ব ভাবলেই অদ্ভুত লাগছে। কোথা দিয়ে জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। কত রকমের ঘটনা, অভিজ্ঞতা, কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল এই জীবনে। তবে মন থেকে আমি কখনওই নিজেকে ৮১, বা বৃদ্ধ মনে করি না। এখন তো আবার নতুন করে কাজ শুরু করার স্বপ্ন দেখি রোজ।
৭ মার্চ জন্মদিন (আজ), আর ১০ তারিখ কিছু সারপ্রাইজ দেবেন শুনেছি। আবার কি ছবি পরিচালনায় আসছেন? কিছুদিন আগে বিজ্ঞাপনের ছবিও করেছেন।
– ৭ তারিখ জন্মদিন আর ১০ তারিখ মেয়ে একটা বড় পার্টি আয়োজন করছে, তবে কী সারপ্রাইজ সেটা এখন থেকে বলে দিলে, আর সারপ্রাইজ থাকে কী করে (হাসি)। সব মেয়ে (একতা) প্ল্যান করেছে। ১০ তারিখ অবধি একটু অপেক্ষা করতে হবে।
আপনি ছবি করা নিয়ে এতটাই আশাবাদী? প্রযোজনা সংস্থাও খুলেছেন…
– শেষ দুটো ছবি সেইভাবে চলেনি। ২০১১ সালেই ঠিক করেছিলাম আর ছবি করব না। ইন্ডাস্ট্রির কাজের ধরন পালটাচ্ছিল। মানুষের ভালোলাগা বা না-ভালোলাগা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ১২-১৩ বছর প্রায় সব কিছু থেকে দূরে ছিলাম। কিন্তু একতা জীবনে আসার পর সমস্ত ভাবনাচিন্তা পালটে গেল। মনের জোর বেড়ে গেল। ও বারবার বলতে থাকল, তুমি এখনও ফুরিয়ে যাওনি। তাই গত বছর ফাদার্স ডে-তে ও আমার নামেই একটা প্রোডাকশন হাউস উপহার দেয় আমাকে, আর তার আন্ডারে আমি প্রথমবার বিজ্ঞাপনে কাজ করি। সামনে আরও একটা বিজ্ঞাপনের কাজ আছে। তা ছাড়া এখন আবার সেটে অ্যাকশন-কাট বলতে মন চাইছে। ভাবনাচিন্তা চলেছে।
আপনার আত্মজীবনী ‘ক্ল্যাপস্টিক’ গতবছর পাঠকের সামনে এসেছে। মানুষের এত ভালো লাগল কেন? কী মনে হয়?
– মনে হয় মানুষ যেভাবে প্রভাত রায়কে দেখতে চায় বা যেভাবে চেনে সেই ভাবেই বইয়ে তারা আমাকে পেয়েছে। তাদের নিজেদের জীবনের সঙ্গে আমার জীবন সংগ্রাম, বিভিন্ন মুহূর্ত রিলেট করতে পেরেছে। আমার জীবনটাই অদ্ভুতভাবে সিনেমার মতো। যাঁরা ‘ক্ল্যাপস্টিক’ পড়েছেন তাঁরা বুঝতে পারবেন, কেন এটা বলছি। তাছাড়া আমার মনে হয়, আমি আর বাবলা (একতা) খুব সহজভাবে গল্প করার ছলে বইটা লিখেছি। অনেকেই বলেছে, তারা একবার শুরু করে বইটা না শেষ করে পারেনি।
নিয়মিত আপনাকে ডায়ালিসিস করাতে হয়, বার্ধক্যজনিত সমস্যাও আছে। এত কিছুর মধ্যে কোন চিন্তা সবচেয়ে বেশি গ্রাস করে?
– সে রকম কোনও চিন্তা আমার নেই। জীবনে যতটুকু সম্ভব সঞ্চয় করেছি। যদিও তার পূর্ণ কৃতিত্ব আমার স্ত্রী জয়শ্রীর। সেই আমাকে জোর করে সংসারী করেছিল, অর্থ সঞ্চয় করতে শিখিয়েছিল। আর কোনওদিন বিলাসবহুল জীবন আমি কাটাইনি। এখন একটাই ভয় হয়, হঠাৎ করে যেন মেয়েটাকে ছেড়ে চলে না যেতে হয়। আরও কিছু বছর ওর সঙ্গে কাটাতে চাই। আমাদের সন্তান ছিল না। জয়শ্রী চলে যাওয়ার পর আমার ভাবতে ভালো লাগে যে, ও-ই একতাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। ওটাই একমাত্র বাঁচার রসদ এখন।
২০২২ সালে স্ত্রীকে হারানোর পর প্রভাত রায় থেকে ‘বাবি’ হয়ে গেলেন, কন্যা একতা ভট্টাচার্যর সৌজন্যে। আপনার জীবনে তাঁর ভূমিকা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
– আগে যারা জিজ্ঞেস করত, প্রভাতদা কেমন আছে, এখন অনেকে বাবলাকে জিজ্ঞেস করে, বাবি কেমন আছে? লাইফের ইন্টারেস্টিং চেঞ্জটা বেশ এনজয় করছি। প্রায় ৮০ বছর বয়সে প্রথম সন্তানসুখ উপলব্ধি করার আনন্দই আলাদা। আমি যখন জীবনে একাকীত্বে ভেঙে পড়েছিলাম, বিভিন্ন অনিয়মে শরীর শেষ হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় বাবলা আমার জীবনে এসে আমার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিল। হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে এসে আমার যত্ন করে আমাকে সুস্থ করে তুলল। আবার আমাকে কাজে ফেরাল, দুজনে মিলে বই লিখলাম, বইটা বেস্ট সেলার হল। বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড ফাংশনে নিয়ে যেতে শুরু করল। দুজনে আগের বছর প্রচুর অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছি। এবং আগামী দিনেও ও আমার জন্য আরও অনেক কিছু প্ল্যান করে রেখেছে। ডাক্তারের কাছে রেগুলার চেকআপ থেকে, কবে কী খাব বা কোন দিন কী জামা পরব, সব ও ঠিক করে দেয়। একটা শেষ হয়ে যাওয়া মানুষকে বাঁচার নতুন আলো দেখাল মেয়েটা।
এক সময় অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসাবেও কাজ করেছেন। তারপর পরিচালক হয়ে গেলেন কীভাবে?
– প্রথমেই অভিনেতা হতেই গিয়েছিলাম। সুযোগ পাচ্ছিলাম না। কারণ কম বয়সে স্টেজে অভিনয় করেছি, কলেজ জীবনেও। তো অভিনয় করার নেশা ছিল। ডিরেক্টর অজয় বিশ্বাস বললেন, তুই টেকনিক্যাল কাজ শেখ আগে, পরে সুযোগ পেলে ডিরেক্টর হয়ে যাবি। পরে যদি সুযোগ আসে অ্যাক্টর হবি শিখতে শিখতে। নেশা হয়ে গেল। টেকনিক্যাল কাজ শিখতে শিখতে টেকনিশিয়ান হয়ে গেলাম একসময়। ডিরেক্টর হওয়ার পরে দেখলাম, একজন পরিচালকের যা সম্মান, কোনও আর্টিস্টের চেয়ে কম নয়। কারণ, তার কথা অনুযায়ী সব হয়। তার অ্যাকশন-কাট-এর উপর সব নির্ভর করে। তার গুরুত্ব অনেক বেশি। আর একজন ডিরেক্টরের ভাবনার উপরে গোটা সিনেমা পরিধি দেখা যায়। তার সমস্ত ডিপার্টমেন্টের দিকে সমান নজর রাখতে হয়। প্রত্যেকটা সিনেমা এক একটা চ্যালেঞ্জের মতো, কিন্তু আমি এই প্রসেসটা খুব এনজয় করেছি।
আজকে ইন্ডাস্ট্রির কোন বিষয়টা নিয়ে আক্ষেপ হয়?
– দুটো আক্ষেপ আছে। একটা হচ্ছে, অডিয়েন্সকে মিসগাইড করা হয়। অনেক ছবি চলছে না, সেগুলোর এমন পাবলিসিটি করা হয়, যেন দারুণ হিট। দর্শককে বোকা বানানো বন্ধ করা উচিত, ভুল বক্স অফিস কালেকশন দেওয়া বন্ধ হোক। এটা বিগত কয়েক বছরে অনেকটা বেড়ে গেছে। আরেকটা হল, ছবি বানাতে গেলে গ্রাম-শহর দুয়ের দর্শকের জন্যই বানাতে হবে। কোনও একটার জন্য ভাবলে হবে না। সেটা কম হচ্ছে বলে সিনেমার এই অবস্থা। শুধু মাল্টিপ্লেক্সের কথা ভাবলে চলবে না, সিঙ্গল স্ক্রিনের কথাও ভাবতে হবে।
এই সময়ের অনেক তারকাই আপনার হাত ধরে শুরু করেছিলেন। রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ কতটা?
– আমি ফিল্মে অনেককেই সুযোগ দিয়েছি যারা আজকের যুগে প্রতিষ্ঠিত। তার মধ্যে টোটা, মাকু মানে পল্লবী এবং ঋতুপর্ণা, এরাই শুধু আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ‘পল্লবী’ নামটাও আমারই দেওয়া।
এখন তারকাদের অনেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। এতে ইন্ডাস্ট্রির ভালো হয়েছে, না ক্ষতি হয়েছে? কী মনে করেন?
– তারকাদের যদি এত মিটিং-মিছিলে দেখা যায়, তাহলে টিকিট কেটে মানুষ আলাদা করে পর্দায় দেখতে চাইবে কেন? অভিনেতা-অভিনেত্রীদের শুধু অভিনয় নিয়েই থাকা উচিত। সেটাই ভালো। অন্য জগতে প্রবেশ করলেই, সে রাজনীতি বা অন্য কোথাও, তার নজর ঘুরে যায়। একবার উত্তমকুমার সুখেনদাকে বলেছিলেন, যে- ‘তুই এত বাজার-দোকানে ঘুরে বেড়াস, লোকে তোকে সবসময় দেখে, এটা ঠিক না। সবসময় দেখলে পয়সা খরচ করে দেখার ইচ্ছেটা চলে যায়।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন