পারমিতা রায়, শিলিগুড়ি: ল্যাপটপ পেছনে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘেদের দল। পড়ন্ত বিকেলে কমলা আভা ছড়িয়ে পাহাড়ের খাঁজে ডুব দিচ্ছে সুয্যিমামা। জানলার ওপার থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। আর ল্যাপটপ স্ক্রিনে তখন চলছে ভার্চুয়াল মিটিং। হাতের কফি কাপ থেকে নয়, বরং ধোঁয়া উঠছে টেবিলে রাখা গরম মোমোর প্লেট থেকে। এটা এখন আর কল্পনা নয়, বাস্তব।
আসলে করোনা অতিমারির পর বদলেছে কাজের ধরন, বদলেছে মানুষের ভাবনাও। দমবন্ধ করা ফ্ল্যাট ছেড়ে অনেকেই এখন পাহাড়ের কোলে খুঁজছেন অফিসঘর।
সিকিমের (Sikkim) ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম ইয়াকতেন (Yakten)। সদ্য এই গ্রামকে ঘোষণা করা হয়েছে দেশের প্রথম ডিজিটাল নোম্যাড ভিলেজ হিসেবে (Digital Nomad Village)। প্রকৃতি আর প্রযুক্তির মেলবন্ধনে ইয়াকতেন এখন অভিনব কর্মস্থল। নোম্যাড সিকিমের আওতায় এই গ্রামে মিলছে হাইস্পিড ইন্টারনেট, ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ। সঙ্গে রয়েছে পরিবেশবান্ধব হোমস্টে ও কাজের উপযোগী পরিকাঠামো। যার টানেই দিল্লি, বেঙ্গালুরু, কলকাতার মতো শহর থেকে এখন অনেকেই খোঁজ নিচ্ছেন ইয়াকতেনে থেকে ক’টা দিন ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করার জন্য।
গ্রামটি পাকিয়ং বিমানবন্দরের একেবারে গা ঘেঁষে। সিকিম-বাংলা সীমানা থেকে সড়কপথে দূরত্ব মেরেকেটে ৪০ কিলোমিটার। ইয়াকতেনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে কালিম্পংয়ের যে কোনও পাহাড়ি গ্রাম। দার্জিলিংও বা কম যায় কীসে! ফলে ইয়াকতেনের মতো এখানকার যে কোনও পাহাড়ি অঞ্চলও হয়ে উঠতে পারে ‘ওয়ার্ক ফ্রম ডেস্টিনেশন’-এর আদর্শ জায়গা। কিন্তু আক্ষেপ একটাই, ডিজিটাল জমানায় দাঁড়িয়ে এখনও মোবাইল হাতে নেটওয়ার্ক খুঁজে বেড়ানো।
কালিম্পংয়ের আলগাড়ার কাছে ক’দিন আগে বেড়াতে গিয়েছিলেন দত্তপুকুরের সমীর হালদার ও তাঁর বন্ধুরা। দুই রাত ছিলেন মায়রুং ভ্যালির কাছে একটি হোমস্টেতে। শিলিগুড়িতে ফিরেই একরাশ আক্ষেপ সমীরের গলায়, ‘প্রকৃতি দেখে তো মুগ্ধ। কিন্তু ওদিকে বাড়ির লোকজন তো ফোনে না পেয়ে চিন্তায় শেষ। মাঝে মাঝে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়, কিন্তু কথা শোনাই যায় না সেভাবে। ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া তো দূর কি বাত।’ তাঁর মতো অভিজ্ঞতা অনেকেরই। ৫জির জমানায় যেখানে দুরন্ত গতিতে ছোটার কথা অন্তর্জালে, সেখানে এমন কিছু জায়গায় ২জি নেটওয়ার্ক পাওয়াই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
দেশে করোনা পরিস্থিতির পর থেকে ‘ওয়ার্ক ফ্রম ডেস্টিনেশন’-এর চাহিদা যে উত্তরোত্তর বেড়েছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। দেশের বড় বহুজাতিক সংস্থাগুলি তো বটেই, আজকাল প্রচুর ছোট সংস্থাও ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সুযোগ দিচ্ছে। বদ্ধ ঘরে হাঁপিয়ে ওঠা প্রাণ তাই একটু স্বস্তির বাতাস নিতে খুঁজে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি কোনও গ্রাম। এক্ষেত্রে উত্তরের পাহাড়েও চাহিদা কিন্তু আকাশছোঁয়া।
দার্জিলিং পাহাড়ের তাকদা, বিজনবাড়ি থেকে শুরু করে কালিম্পংয়ের লুংসেল, ইচ্ছেগাঁওয়ের মতো জায়গায় অনেকেই আসছেন ওয়ার্ক ফ্রম ডেস্টিনেশনের জন্য। তালিকায় আছে লাভা, সিটং, বেলটার, তাবাকোশি, রঙ্গোর মতো জায়গাও।
কথা হচ্ছিল বিজনবাড়ির এক হোমস্টের মালিক নরবু লামার সঙ্গে। তিনি বলছেন, ‘অনেকেই এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করেন। ঘুরতে এসেও তাই কাজ করতে হয় অনলাইনে। আগের চাইতে আমাদের এখানে নেটওয়ার্ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হয়েছে। তাই আসা-যাওয়াও বাড়ছে। তবে, সরকারিভাবে পরিকাঠোমোর উন্নতি হলে এই চাহিদা আরও বাড়বে।’
ইয়াকতেন পারলে আমরা পারব না কেন, প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে তাকদাতেও। সেখানকার হোমস্টের মালিক দিওয়াসকার ছেত্রীর কথায়, ‘এই ধরনের গেস্টরা মূলত ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য আসেন। কেউ কেউ আবার মাসের পর মাসও থাকেন। তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাটাও একটু আলাদা থাকে। দামেরও কিছুটা ফারাক রাখতে হয়।’ দিওয়াসকারের সংযোজন, ‘চাহিদা দিন-দিন বাড়ছে। আমরা যতটা সম্ভব ইন্টারনেট কিংবা অন্য সুযোগসুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সরকারি তরফেও এই চেষ্টাটা থাকলে পর্যটনের মানোন্নয়ন হবে।’
অনেকেই আছেন যাঁরা নিজে রান্না করে খেতে চান, কাজের পাশাপাশি পাহাড়ি জীবনযাপনের আনন্দও নিতে চান, তাঁদের জন্য সেই ব্যবস্থাও রাখা হয় বলেই জানাচ্ছিলেন সিটংয়ের লামসি ছেত্রী। গতবছরই ‘ওয়ার্ক ফ্রম ডেস্টিনেশন’-এর জন্য প্রায় ১৫ দিন তাকদায় গিয়েছিলেন রাজদীপ সাহা, শুভ্র দাস রায়রা। শুভ্রর কথায়, ‘আমি বেঙ্গালুরু থেকে যখন শিলিগুড়িতে ফিরি, তখন কয়েকটা দিন পাহাড়ে কাটিয়ে আসি। অফিস তো কামাই করা যায় না। তাই সেখানে থেকেই কাজ করতে হয়। কিছু কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কে সমস্যা হয়। তবে, এটা এক আলাদা অনুভূতি।’
শুভ্র, নরবু, দিওয়াসকাররা প্রত্যেকেই কিন্তু একটা বিষয়ে একমত যে, ইয়াকতেনের পথ অনুসরণ করে সঠিক সরকারি পরিকল্পনা ও সহযোগিতা পেলে উত্তরের পাহাড়ি এই গ্রামগুলিও হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের ‘ডেস্টিনেশন ভিলেজ ফর রিমোট ওয়ার্ক।’
তাঁরা যে ভুল কিছু ভাবছেন না, সেকথা কবুল করছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরাও। হিমালয়ান হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক সম্রাট সান্যাল বলছেন, ‘দুটো জিনিসে সবার প্রথমে জোর দেওয়া উচিত। এক, নেটওয়ার্ক, দুই, যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাহলেই কেল্লা ফতে।’