শিলিগুড়ি: ‘উই ওয়ান্ট গোর্খাল্যান্ড’ আওয়াজ এখন আর ধাক্কা খায় না পাহাড়ের গায়ে। বনধ ভুলেছে শৈলরানি। কিন্তু দার্জিলিংয়ের ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে’ এখন ঘনঘটা। দিনকয়েকের বৃষ্টিতে ফার্স্ট ফ্লাশ নিয়ে যখন আশার আলো ডুয়ার্সে, তখনই চরম ধাক্কা লাগল পাহাড়ি চায়ে। টি বোর্ডের তথ্যে স্পষ্ট, বনধের ২০১৭-কে বাইরে রাখলে গত বছরই ১৬৯ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কম উৎপাদন হয়েছে দার্জিলিং চায়ের (Darjeeling Tea)। এমন হতাশাজনক পরিস্থিতির জন্য কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অনিচ্ছা, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, একের পর এক বাগান নতুন গোষ্ঠীর হাতে চলে যাওয়া, ১২টি চা বাগান বন্ধকে বড় করে দেখানো হলেও মূল কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে আগামীর সঙ্গে যুঝবে দার্জিলিং চা?
দার্জিলিংয়ে উৎপাদিত ‘সিলভার নিডেল হোয়াইট টি’ কিছুদিন আগে এক কেজি পাঁচ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি হওয়ায় কম হইচই হয়নি। বিশ্বের বিরলতম এমন চা উৎপাদন করে চিনের ফুজিয়ানকে টেক্কা দিয়েছে ভারতের শৈলরানি, সে সময় বক্তব্য ছিল অনেকের। কিন্তু বাস্তব ছবিটা যে ভিন্ন, স্পষ্ট হয়ে গেল টি বোর্ডের প্রকাশিত তথ্যে।
ওই তথ্য অনুসারে, ’২৪-এ দার্জিলিংয়ে চা উৎপাদিত হয়েছে ৫.৬ মিলিয়ন কেজি। যা ’২৩-এ ছিল ৬ মিলিয়ন কেজির কিছুটা বেশি। ’১৭ সালকে বাইরে রাখলে এত কম উৎপাদন সর্বকালীন রেকর্ড। রাজ্য সরকারের সঙ্গে বিমল গুরুংদের বিবাদে ’১৭-তে পাহাড় সাক্ষী থেকেছে নজিরবিহীন টানা ১০৪ দিন বনধের। ফলে ওই বছর দার্জিলিংয়ে চা উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.২১ মিলিয়ন কেজি। যা পাহাড়ের চা বাগানে অশনিসংকেত ডেকে এনেছিল।
গত শতাব্দীর সাতের দশকেও দার্জিলিংয়ে চা উৎপাদন হত ১০ মিলিয়ন কেজির বেশি। অর্থাৎ সাড়ে পাঁচ দশকে প্রায় ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমেছে।
এখন পাহাড়ের শাসকদলের সঙ্গে রাজ্য সরকারের মধুর সম্পর্ক। নেই পৃথক রাজ্যের দাবিতে কোনও আন্দোলন বা টানা বনধ। তাহলে কেন উৎপাদনে মার খাচ্ছে দার্জিলিংয়ে? চা শিল্পপতিদের একাংশের বক্তব্য, আন্দোলন না থাকলেও শ্রমিকদের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। এখন বাগানের কাজে অনিয়মিত শ্রমিকরা। ইচ্ছে হলে তাঁরা বাগানে আসেন, অন্যথায় ঘরে বসে থাকেন। এ কারণে আগে যেখানে বছরে ২৫-৩০ বার চা পাতা তোলা হত, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬-১৮’তে। এছাড়াও রয়েছে পরিচর্যার খরচ বৃদ্ধি। এক সময় পুরোনো চা গাছ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি খরচ হত ৩ লাখ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। এমন সমস্যার সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তন বিপদ ডেকে এনেছে বলে মনে করছেন চা শিল্পপতিদের বড় অংশ।সিসিপিএ’র সেক্রেটারি জেনারেল অরিজিৎ রাহা বলছেন, ‘অন্য সমস্যা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ুর সমস্যা। যা মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই।’ তবে এমন পরিস্থিতির জন্য শ্রমিকদের একাংশ মনে করছেন, মোট উৎপাদনে ঘাটতির মূলে রয়েছে বন্ধ ১২টি চা বাগানও। তাছাড়া একাধিক চা বাগান এখন পরিচালিত হচ্ছে নতুন মালিকের হাতে। ফলে পরিচর্যার দিকে তাঁরা সেভাবে নজর দিচ্ছেন না। তবে আবহাওয়ার পরিবর্তন যে পরিস্থিতির বদল ঘটিয়েছে, তা অস্বীকার করছেন না তাঁরা।