কোচবিহার: দেওদেখার মধ্য দিয়ে পাঁচ শতাধিক বছরের প্রাচীন কোচবিহারের পুজো শুরু হয়ে গেল। রাজ আমলের রীতি মেনে মঙ্গলবার দ্বিতীয়া তিথিতে দুয়ারবক্সি অজয় দেববক্সি ও জেলাশাসক অরবিন্দকুমার মিনা বিশাল আকৃতির কোশাকুশিতে বড়দেবীর প্রতিচ্ছবি দেখেন। বহু পূণ্যার্থী মঙ্গলবার এই পুজো দেখতে দেবীবাড়িতে বড়দেবীর মন্দিরে ভিড় করেন। দেওদেখার পর জেলাশাসক তথা দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি অরবিন্দকুমার মিনা বলেছেন, ‘রাজ আমলের নিয়মকানুন মেনেই পুজো হচ্ছে। সকলে যাতে ভাল থাকেন বড়দেবীর কাছে সেই প্রার্থনাই করলাম।’
অন্যান্য দুর্গাপুজোর চেয়ে কোচবিহারের বড়দেবীর পুজোর নিয়মরীতিতে বেশকিছু বদল রয়েছে। শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে ডাঙ্গরাই মন্দিরে ময়নাকাঠের পুজো করা হয়। সেই ময়নাকাঠের উপরই বড়দেবীর প্রতিমা গড়ে তোলা হয়। ময়নাকাঠের পুজোর পর সেটি মদনমোহনবাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে একমাস ধরে বড়দেবীর পুজো চলে। যা যূপ পুজো নামে পরিচিত। ভাদ্র মাসের রাধা অষ্টমী তিথিতে সেই ময়নাকাঠ বড়দেবীর মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মহাস্নান সেড়ে পুজো ও তিনদিন ধরে হাওয়া খাওয়ানো হয়। এরপর সেখানে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেন মৃৎশিল্পীরা। প্রতি অষ্টমী তিথিতে গৃহপুজো করা হয়। এরপর প্রতিপাদতে ঘটস্থাপনের পর দ্বিতীয়া তিথিতে বড়দেবীকে সাজিয়ে দেওদেখা হয়। রাজ আমলের নিয়ম মেনে রাজ পরিবারের ধর্মীয় প্রতিনিধি অজয়কুমার দেববক্সি দেওদেখেন। তাঁর কথায়, ‘বড় মাপের কোশাকুশিতে জল রেখে সেখানে বড়দেবীর প্রতিচ্ছবি দেখা হয়।’ পুরোহিত দীনেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বড়দেবীর পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন। পুজোর ফাঁকে তিনি বললেন, ‘অন্যান্য পুজোর তুলনায় বড়দেবীর পুজোর নিয়মে কিছু বদল থাকে। রাজ আমল থেকেই সেই নিয়মেই পুজো হয়ে আসছে।’
দ্বিতীয়ার পুজোতে পরমান্ন ভোগের পাশাপাশি জোড়া পায়রা বলি হয়েছে। পরবর্তীতে অষ্টমী তিথিতে মহিষ বলি দেওয়া হবে। পুজোর দিনগুলিতে পায়রা, মহিষের পাশাপাশি পাঁঠা, মাগুর মাছ বলি দেওয়া হয়। কথিত রয়েছে, একসময় নাকি এই পুজোয় নরবলি দেওয়া হত। তবে সেই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এখনও বড়দেবীর পুজোয় নররক্ত উৎসর্গ করা হয়। রাজপুরোহিত হীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘অষ্টমী তিথির গভীর রাতে গুপ্তপুজোর সময় নররক্ত উৎসর্গ করা হয়।’
অন্যান্য দুর্গা প্রতিমার থেকে বড়দেবীর প্রতিমাতেও বদল রয়েছে। এখানে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশের বদলে দেবীর সঙ্গে থাকেন জয়া-বিজয়া। কথিত রয়েছেন, মহারাজা বিশ্বসিংহ ছোট বেলায় ভাই ও বন্ধুদের নিয়ে বনে খেলার ছলে একটি ময়নাকাঠকে দেবীরূপে পুজো করেছিলেন। সেখানে কুশ দিয়ে তৈরি একটি খড়্গ দিয়ে এক বন্ধুকে বলি দিলে তার মুণ্ডচ্ছেদ হয়। সেই মুণ্ড দেবীকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। ক্লান্ত হয়ে ছোট্ট বিশ্বসিংহ বনে যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তখন দেবীর স্বপ্নাদেশ পান তিনি। তখন থেকেই বড়দেবীর পুজোর সূচনা। এই পুজোকে কেন্দ্র করে কোচবিহারবাসীর যথেষ্ট ভাবাবেগ রয়েছে। বহু মানুষ রয়েছেন যারা বড়দেবীকে প্রথম দর্শন করে তারপরেই অন্য পুজো মন্ডপগুলিতে যান। মঙ্গলবার দেওদেখার পুজো দেখতে এসেছিলেন বৈজুন্তি রায়। তিনি বললেন, ‘বড়দেবীর পুজো না দেখলে আমাদের কাছে দুর্গাপুজো অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই এদিনই পুজো দেখতে এসেছি। পরে আবার আসব।’