শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি : শান ভৌমিকের কুকীর্তি প্রকাশ্যে আসতেই বাংলাদেশি পড়ুয়াদের নিয়ে সতর্ক হল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত সমস্ত বাংলাদেশি ছাত্রকে ভিসা, পাসপোর্ট সহ সশরীরে তাঁর দপ্তরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টুডেন্ট সেল-এর কোঅর্ডিনেটর এবং জয়েন্ট রেজিস্ট্রার স্বপনকুমার রক্ষিত। প্রতিবেশী দেশের পড়ুয়াদের নিয়ে যখন উদ্বিগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন শান ইস্যুতে কার্যত দায় ঝেড়ে ফেললেন শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব। অবৈধভাবে ভারতীয় নথি তৈরি করে বেশ কয়েক বছর থেকে মেয়রের ওয়ার্ডেই ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করছিল শান। তাতেই প্রশ্ন উঠেছে শহরের নিরাপত্তা নিয়ে। সেসব নিয়ে কোনও বাক্য ব্যয় না করলেও এদিন সামাজিক মাধ্যমে একটি দায়সারা বিবৃতি দিয়ে গৌতম শুধু জানিয়ে দেন, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার তালিকায় শান-এর নাম নেই।
খোদ মেয়রের ওয়ার্ডে বসেই বছরের পর বছর ধরে বেআইনি কারবার চালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি ছাত্রের কীর্তি প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল পড়ে যায় শহরে। তারপরই সোমবার দুপুরে ৬৭ শব্দের একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন মেয়র। তাতে তিনি জানান, যে ডেভেলপার ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন তাঁর কাছে ওই বাংলাদেশি ছাত্রের কোনও বৈধ নথিপত্র প্রায় নেই। বৈধ নথিপত্র ছাড়া কেন ফ্ল্যাট বিক্রি করা হল তারজন্য সংশ্লিষ্ট ডেভেলপারের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ হচ্ছে কি না তা অবশ্য জানাননি গৌতম। শান যে অবৈধভাবে ভোটার কার্ড এবং আধার কার্ড বানিয়েছেন তা-ও ঘুরিয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি। আবাসনের এক বাসিন্দার বক্তব্য উদ্ধৃত করে মেয়র লিখেছেন, ‘ছেলেটার আধার কার্ড এবং ভোটার আইডি রয়েছে, তবে সেগুলো এই ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ কোন ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত বিবৃতিতে তার উল্লেখ নেই। প্রশ্ন করা হলেও উত্তর মেলেনি।
বাংলাদেশি ইস্যুতে প্রাক্তন মেয়র অশোক ভট্টাচার্য গৌতমের স্পষ্ট বিবৃতি দাবি করেছেন। তাঁর কথা, ‘ওই বাংলাদেশি ছাত্র কোন ওয়ার্ডের ভোটার তা স্পষ্ট করে বলুন মেয়র। যে কোনও ওয়ার্ডের ভোটার হলেই তার দায় এড়াতে পারেন না মেয়র। পুরনিগম এবং রাজ্য প্রশাসনে তাঁরাই ক্ষমতায় আছেন। তাই জবাব তাঁদেরকেই দিতে হবে।’ শিলিগুড়ির বিধায়ক শংকর ঘোষও শান ইস্যুতে দ্রুত পদক্ষেপ চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পুরসভা সবটাই তৃণমূলের দখলে। তাদের এবং রাজ্য প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদত ছাড়া কোনওভাবেই অবৈধ ভোটার, আধার কার্ড তৈরি করা বাস্তবে সম্ভব নয়। খোদ মেয়রের ওয়ার্ডই যদি বাংলাদেশিদের ঘাঁটি হয় তাহলে অবশিষ্ট শিলিগুড়ির দশা সহজেই অনুমেয়।’
জয়েন্ট রেজিস্ট্রারের দেওয়া তথ্য অনুসারে বর্তমানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনলজি, আইন, টি-সায়েন্স সহ বিভিন্ন বিভাগে ন’জন বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। প্রত্যেক বিভাগীয় প্রধান এবং পড়ুয়াদের আলাদা করে তাঁর দপ্তরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বপন। তিনি জানিয়েছেন, নির্দেশ পেয়ে ইতিমধ্যেই চারজন পড়ুয়া উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদের পাসপোর্ট, ভিসা সহ যাবতীয় নথি যাচাই করা হয়েছে। জয়েন্ট রেজিস্ট্রারের বক্তব্য, ‘শানের ঘটনায় আমরা যথেষ্টই উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি। প্রত্যেক বাংলাদেশি পড়ুয়ার নথি খতিয়ে দেখা হবে। নথিতে গরমিল থাকলে তাকে কোনওভাবেই পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না এবং আইন মেনে পদক্ষেপ করা হবে।’ পদ্ধতি মেনে তাঁরা শানের ভর্তি বাতিল করার প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন বলেই জানিয়েছেন স্বপন।
এসবের মধ্যেই সোমবার শান ইস্যুতে উত্তপ্ত হল ক্যাম্পাস। এদিন সারা বাংলা তৃণমূল শিক্ষাবন্ধু সমিতির নেতা, কর্মীরা জয়েন্ট রেজিস্ট্রারের দপ্তরের সামনে দীর্ঘক্ষণ বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের একজন অধ্যাপক শানের বেআইনি কার্যকলাপকে সমর্থন করে বিভিন্ন জায়গায় বিবৃতি দিচ্ছেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের যোগ্যতা এবং নিয়োগ পদ্ধতি অবৈধ বলেও দাবি করেছেন। সংগঠনের রাজ্য কমিটির সদস্য রণজিৎ রায়ের কথা, ‘যেভাবে ওই অধ্যাপক শানকে সমর্থন করে বিবৃতি দিচ্ছেন তাতে আমাদের ধারণা বাংলাদেশি ছাত্রের অবৈধ কারবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপকের যোগাযোগ আছে। তাই তাঁকে তদন্তের আওতায় আনা হোক। চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা না চাইলে ওই অধ্যাপককে আমরা তাঁর বিভাগে ঢুকতে দেব না।’