উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: জেনারেশন আলফা যখন প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় নিয়ে বেড়ে উঠছে, তখন আরেক প্রজন্ম বেড়ে উঠছে অটিজম (Autism) নিয়ে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যত সহজে সমাজ জেনারেশন আলফাকে মেনে নিচ্ছে, তত সহজে অটিজমকে মেনে নিতে পারছে না। অটিজম সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং ধারণা তৈরি করে সামাজিক কুসংস্কার ও ভুল ধারণা দূর করতে পারলে তবেই অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে সমাজে। বিশেষ এই অবস্থা নিয়ে আলোচনায় তিন বিশেষজ্ঞ।
- অনেক ভুল ধারণা শেষ হোক
শর্মিষ্ঠা দে, স্পেশাল এডুকেটর ও মনোবিদ
ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পেডিয়াট্রিক্সে প্রকাশিত ২০২১ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, ভারতে আনুমানিক ৬৮ জন শিশুর মধ্যে ১ জনের অটিজম হয়ে থাকে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা অটিজমে বেশি আক্রান্ত হয়, যেখানে পুরুষ-মহিলা অনুপাত প্রায় ৩:১। বর্তমান একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভারতে ৯ বছরের কম বয়িস ১.৫ শতাংশ শিশু অটিস্টিক। এই সংখ্যা প্রতি বছর ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই অবস্থায় অটিজম নিয়ে ভুল ধারণা দূর করে কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়তে হবে, যেখানে অটিস্টিক মানুষজনও এই সমাজের অনন্য অংশ হয়ে দাঁড়াবে।
সচেতনতার অর্থ কোনও কিছুর উপলব্ধি বা জ্ঞান। কিন্তু সেই জ্ঞান কিছু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সামাজিকীকরণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অটিজমে আক্রান্ত মানুষজনের কাছে। যেমন-
ভুল ধারণা ১ – অটিজমে আক্রান্ত সকল মানুষ একই রকম।
বাস্তবতা – অটিজম একটি স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, যার অর্থ এটি বিভিন্ন উপায়ে এবং বিভিন্ন মাত্রায় মানুষকে প্রভাবিত করে। কারও বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা থাকতে পারে, আবার কারও গড় বা তার বেশি বুদ্ধিমত্তা থাকতে পারে। অটিজমে আক্রান্ত প্রতিটি ব্যক্তি অনন্য।
ভুল ধারণা ২ – অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান না।
বাস্তবতা – অটিজমে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি সামাজিক মিথস্ক্রিয়া চান, কিন্তু যোগাযোগ বা সামাজিক ইঙ্গিত বুঝতে সমস্যা হতে পারে। অন্যদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের ধরন ভিন্ন হতে পারে, তবে এর অর্থ এই নয় যে তাঁরা সম্পর্ক চান না।
ভুল ধারণা ৩ – অটিজম খারাপ অভিভাবকত্বের কারণে হয়।
বাস্তবতা – অটিজম হল জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি স্নায়ুবিকাশজনিত অবস্থা। এটি অভিভাবকত্বের ধরন বা পছন্দের কারণে হয় না।
ভুল ধারণা ৪ – অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহানুভূতির অভাব রয়েছে।
বাস্তবতা – অটিজমে আক্রান্ত অনেক মানুষ অত্যন্ত সহানুভূতিশীল, কিন্তু তাঁদের আবেগ প্রকাশ করতে বা সামাজিক পরিস্থিতি বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। তাঁদের সহানুভূতি প্রকাশের প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে।
ভুল ধারণা ৫ – অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনোই স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারেন না।
বাস্তবতা – অটিজমে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি স্বাধীনভাবে বা ন্যূনতম সহায়তায় জীবনযাপন করতে পারেন। সঠিক সম্পদ, সহায়তা এবং সুযোগসুবিধা থাকলে, অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পরিপূর্ণ এবং স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারেন।
ভুল ধারণা ৬ – অটিজম নিরাময় করা যেতে পারে।
বাস্তবতা – অটিজম কোনও রোগ নয়, এটি একটি অবস্থা যা জীবনভর বহন করতে হয় অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের।
ভুল ধারণা ৭ – অটিজমে আক্রান্ত সকল ব্যক্তির বিশেষ প্রতিভা বা জ্ঞান বা ক্ষমতা থাকে।
বাস্তবতা – অটিজমে আক্রান্ত সব ব্যক্তির বিশেষ ক্ষমতা থাকে না।
ভুল ধারণা ৮ – অটিজমে আক্রান্ত কিছু ব্যক্তির অসাধারণ ক্ষমতা থাকতে পারে, যেমন গণিত বা সংগীেত।
বাস্তবতা – এটি সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়। অটিজমে আক্রান্ত অনেকেরই কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকে, ঠিক যেমন অটিজমবিহীন ব্যক্তিদের মধ্যেও দেখা যায়।
ভুল ধারণা ৯ – বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অটিজম সেরে যায়।
বাস্তবতা – অটিজম লাইফ লং ডিসঅর্ডার, যা ছোটবেলাতেও থাকবে, মধ্যবয়সেও থাকবে এবং বৃদ্ধাবস্থাতেও থাকবে।
সুতরাং, অটিজম নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আরও সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে অটিস্টিক ছেলেমেয়েরাও এই সমাজের অংশ হয়ে উঠতে পারে।
- পথ দেখাবে বিশেষ ট্রেনিং
রীমা মুখার্জি , ফেসিলিটেটর, শিশুমঙ্গল চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার
রোহান চিরকালই দামাল ছেলে। জীবনে বহু ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু কখনও ভেঙে পড়েনি। ও লড়তে জানে। ছেলের ওই অসুবিধার কথা জানতে পেরেও দমে যায়নি। কিন্তু আজ যখন স্কুল থেকে বেশ স্পষ্টভাবেই বলল, ওরা কোনও দায়িত্ব নিতে পারবে না, তখন আর পারছিল না। কান্নায় ভেঙে পড়ে রোহান।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে সোমা কীরকম অসহায় বোধ করে। ‘লাইফ লং ডিসঅর্ডার’! ও তো কিছু বুঝতেই পারেনি। ক’দিন ধরে ওর আচরণ দেখে একটু অন্যরকম লাগছিল। তবু বুঝতে পারেনি এরকম কিছু শুনতে হবে ওকে।
আদিত্য ভয়ানক দুষ্টু। সবসময় নিজের জগতে রয়েছে। এক জায়গায় বসছে না। সেদিন চোখের এদিক হতেই একটা গোমা সাপ ধরে নিয়ে খেলার চেষ্টা করছে। জামা-প্যান্ট গায়ে রাখতে চায় না। ওর বাবা লটারির টিকিট বিক্রি করে সংসার চালায়। সবাই ওর মাকেই দোষ দেয়। ওর মা বুঝতে পারে না যে কী ভুল করছে। ফলে কপালকেই তিনি দোষারোপ করেন প্রতি মুহূের্ত।
সৃজিত দাসের বাবা পদস্থ অফিসার, দিদি সেন্ট্রাল স্কুলের ফার্স্ট গার্ল, কিন্তু সৃজিতের অদ্ভুত কিছু ব্যবহার পরিবারকে ব্রাত্য করেছে সমাজে। সৃজিত রেগে গিয়ে ভীষণ চিৎকার করে, কামড়ে দেয়, দৌড়ে বেড়ায়। কথা তো বলেই না। আজকাল ওরা কোথাও যেতে চায় না। বড় অস্বস্তিকর লাগে লোকের দৃষ্টি।
এরকম বহু পরিবার বাচ্চা নিয়ে এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছে। এদের দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। রাস্তায় ঘাটে, শপিং মলে, ট্রেনে বাসে আজকাল প্রায়শই দেখা যায়। বাচ্চাগুলো যেন আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে একটু অন্যরকম। চিকিৎসাশাস্ত্রে এর নাম অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার। এই সমস্যা নিয়ে প্রচুর কথা হচ্ছে। পোস্টারে, পেপারে, ফেসবুকে বিভিন্ন জায়গায় অটিজম নিয়ে নানা লোক নানা কথা বলছে দেখছি।
অটিজম স্পেকট্রাম একটি নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার। এদের অসুবিধাগুলো একটু অন্যরকম। যেমন, কথা বলতে পারলেও সামাজিক পরিবেশে কথোপকথন তাদের জন্য কঠিন। প্রশ্ন করলে ঠিক তখনই উত্তর নাও পেতে পারেন। এটি ইচ্ছাকৃত নয়, অসুবিধা। একই ধরনের কাজ বারবার করা, একই রকমের খেলা, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে না পারা, সাধারণ শব্দে বিরক্ত হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করা ইত্যাদি এদের মধ্যে দেখা যায়। আবার বেশিরভাগ সময়ই বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। অথচ সাধারণ কথা বুঝতে পারছে না, শুনতে পায়, কিন্তু মর্জিমাফিক শোনে, কথা বলতে পারে, কিন্তু বলে না। প্রয়োজনের জিনিস ইশারা করে ঠিক বুঝিয়ে দেয়। ফলে অবাক লাগে, ভুল বোঝাবুঝি হয়।
প্রশ্ন হল অটিজম কেন হয়? এর বিজ্ঞানসম্মত কোনও নির্দিষ্ট কারণ নেই। তবে সম্ভাব্য কারণের মধ্যে রয়েছে –
জিন বা বংশপরম্পরাঃ আমরা জানি জিন আসলে সভ্যতার ধারক ও বাহক। এক প্রজন্মের দোষ, গুণ, বিশেষ ক্ষমতা এই জিনের মাধ্যমে আরেক প্রজন্মে পরিবাহিত হয়। জিন নিয়ে যেসব বিজ্ঞানী কাজ করছেন, তাঁদের মতে আমাদের শরীরের অসংখ্য জিনের মধ্যে কখনো-কখনো কোনও জিনের কোনও সুপ্ত বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্মে হঠাৎ দেখা যেতে পারে। মোট কথা, এই অটিজমের পেছনে জিনের কোনও কারিকুরি অবশ্যই আছে।
পরিবেশঃ ভ্রূণ অবস্থা থেকে শিশু কোন পরিবেশে বড় হচ্ছে, সেটি কিন্তু একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। প্রসূতি মায়ের পরিবেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যাভ্যাসও একটা কারণ বলে অনেকে মনে করছেন।
স্নায়ুর ভূমিকাঃ আমরা ছোটবেলায় পড়েছি স্নায়ুকোষের শেষভাগটি অনেকটা শুঁড়ের মতো। এগুলোকে সাইন্যাপস বলে। এই সাইন্যাপসের সমস্যা থেকেও অটিজম হওয়ার প্রবণতা থাকে। সেরোটোনিন, ডোপামিন ইত্যাদি হরমোনের এদিক-ওদিক হলেও অটিজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সময়ের আগে শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়াঃ আজকাল বিভিন্ন কারণে শিশু সময়ের আগেই ভূমিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে লেট প্রিটার্ম। এই লেট প্রিটার্ম অটিজমের কোনও কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এপিজেনেটিক্সঃ পরিবেশ এবং জিনের সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় নিউরোডেভেলপমেন্টাল সমস্যাগুলো দেখা দেয়। তাই এপিজেনেটিক্সের ভূমিকা নিয়েও কিন্তু গবেষণা চলছে।
এইসব সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা চলছে, গবেষণা চলছে। তবু অটিজম ঠিক কী কারণে হচ্ছে তা এখনও ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট তথ্য সেভাবে পাওয়া যায়নি।
তবে অটিজম চিহ্নিতকরণ মানেই কিন্তু জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। অটিজম কোনও অসুখ নয়, একটা অবস্থা। যেহেতু অসুখ নয়, ফলে অটিজম কমিয়ে দেওয়ার কোনও ওষুধ নেই। কিন্তু কিছু উপায় আছে, ট্রেনিং আছে যার সাহায্যে অটিজম আছে এমন মানুষজন তাঁদের জীবন গুছিয়ে নিতে পারেন। অটিজম আছে এমন মানুষ ডাক্তার হয়েছেন, থেরাপিস্ট হয়েছেন, লেখক, কবি, আর্টিস্ট, মডেল, হোটেল, বাণিজ্যে আছেন এমন সংখ্যা বেশি না হলেও অপ্রতুল নয়।
এমন বহু মানুষ যাঁরা স্পেকট্রামে আছেন তাঁরা অনেক কিছু করছেন। এই অনেক কিছুটা আমরা সবসময়ই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যােন্টর বাইরে কিছু ভাবতে পারি না। কিন্তু যদি মানুষের ভেতরের গুণগুলিকে বাইরে আনতে পারি, তাহলে তাঁদের জীবনও পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
এটা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে, অটিজম একধরনের অক্ষমতা যা বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। ফলে ভুল হয়ে যায়। মানুষটির অসুবিধাটাকে আমরা অনেক সময় বদমাইশি, অসভ্যতা, বাবা-মায়ের দোষ বলে চালাতে চেষ্টা করি। তাদের আলাদা করে দিতে চাই।
২০৩০ সালের ইউনাইটেড নেশনের মূল লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিকরণ। অর্থাৎ এই পৃথিবী সবার জন্য। সবাই যেন সবরকমের সুবিধা পেতে পারে। অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে আমরা যদি এত সংখ্যক মানুষকে সমাজে ব্রাত্য করে রাখি, তার দায়ভার কিন্তু আমাদের ওপরই বর্তাবে।
বাবা-মায়েরা যাঁরা বিহ্বল হয়ে রয়েছেন নিজের শিশুটিকে নিয়ে তাঁদের উদ্দেশে বলি, আপনার সন্তানের ওপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখুন। সঠিক ট্রেনিং পেলে স্পেকট্রামে থাকা মানুষজন সুন্দর জীবন ফিরে পেতে পারেন। দরকার আর্লি ইন্টারভেনশন অর্থাৎ দ্রুত শনাক্তকরণ। যদি আপনার সন্তানকে নিয়ে আপনার মনে এতটুকু সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়, ডেভেলপমেন্টাল পেডিয়াট্রিশিয়ােনর পরামর্শ নিন। অযথা দেরি করবেন না।
সচেতনতা বাকি সবার জন্য, যাতে এইসব মানুষকে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ দিতে পারি। সেইসব পরিবারের পাশে থাকতে পারি। তাদের যেন আলাদা না করে দিই। তাদের প্রতি অনুকম্পা নয়, সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে তারা যেন থাকতে পারেন। মনে রাখতে হবে এই পৃথিবীর সব ভালো জিনিসের ওপর আমাদের যেমন অধিকার, তাদেরও সমান অধিকার।
- আমার বাচ্চা একটু অন্য রকম …
ডাঃ এমএম সামিম, বিশেষজ্ঞ চাইল্ড ও অ্যাডাল্ট নিউরোলজিস্ট, নেওটিয়া গেটওয়েল মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটাল
অটিজম মানেই অসুস্থ বা কোনও রোগ আছে এমন নয়। এর অর্থ অটিস্টিক মানুষজনের মস্তিষ্ক অন্যদের থেকে ভিন্নভাবে কাজ করে। অটিস্টিকরাও ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। তঁারা ভালো বন্ধু হতে পারেন, তঁারা সম্পর্ক গড়তে পারেন, তঁারা চাকরি করতে পারেন- শুধু এই সবকিছুতে তাঁদের অতিরিক্ত সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। এই পর্বে অটিজম সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নোত্তর থাকল।
প্রশ্ন অটিজম কি মানসিক রোগ? এটি কি পাগলামি?
উত্তর না, অটিজম কোনও মানসিক রোগ বা পাগলামি নয়। এটি মস্তিষ্কের বিকাশজনিত একটি সমস্যা, যেখানে শিশু সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন হলেও সামাজিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনে সমস্যা অনুভব করে। তারা চোখে চোখ রেখে কথা বলে না, অন্যদের সঙ্গে মিশতে চায় না এবং কিছু কাজ বারবার করার প্রবণতা দেখায়।
প্রশ্ন অটিজম কি খুব বিরল একটি অবস্থা?
উত্তর না, এটি বিরল নয়। প্রতি ৬৮ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি)-এ আক্রান্ত হয়।
প্রশ্ন শিশুটি যদি অন্যদের সঙ্গে সহজে মিশতে না চায়, নিজের মতো থাকে, তাহলে কি তা অটিজমের লক্ষণ?
উত্তর হ্যাঁ, এটি অটিজমের লক্ষণ হতে পারে। যদি শিশু মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে না চায়, চোখে চোখ রেখে কথা না বলে, কথা বলার ক্ষমতা হারায় বা দেরিতে কথা বলা শুরু করে, অকারণে চিৎকার করে বা কাঁদে এবং একই কাজ বারবার করে।
প্রশ্ন অটিজম কি শুধু ছেলেদের হয়?
উত্তর না, যদিও ছেলেদের মধ্যে এটি চারগুণ বেশি দেখা যায়, তবে মেয়েরাও আক্রান্ত হতে পারে।
প্রশ্ন অটিজম কি শুধুমাত্র জিনগত কারণে হয়?
উত্তর না মাত্র ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জিনগত কারণ পাওয়া গিয়েছে। পরিবেশগত কারণ, মস্তিষ্কের গঠনগত সমস্যা এবং স্নায়ুতন্ত্রের ব্যাধিও ভূমিকা রাখে।
প্রশ্ন একটি শিশুর অটিজম থাকলে কি অন্য ভাইবোনদেরও হতে পারে?
উত্তর হ্যাঁ, যদি পরিবারের একজন শিশু অটিজমে আক্রান্ত হয়, তাহলে অন্য সন্তানের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা ১০-২০ শতাংশ বেড়ে যায়।
প্রশ্ন বাবা-মায়ের কারণে কি শিশু অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে?
উত্তর সরাসরি নয়,তবে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারণ রয়েছে। যেমন – ৩০ বছরের পর গর্ভধারণ করলে, গর্ভাবস্থায় কিছু ওষুধ খেলে এবং মায়ের ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজনাধিক্য থাকলে।
প্রশ্ন কম ওজন বা সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুর কি অটিজম হওয়ার ঝঁুকি বেশি?
উত্তর হ্যাঁ, প্রিম্যাচিউর (সময়ের আগেই জন্ম নেওয়া) বা কম ওজনের শিশুদের মধ্যে অটিজম বেশি দেখা যায়।
প্রশ্ন টিকা নেওয়ার কারণে কি অটিজম হয়?
উত্তর না এখন পর্যন্ত কোনও গবেষণায় টিকা ও অটিজমের মধ্যে কোনও সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
প্রশ্ন অতিরিক্ত মোবাইল বা টিভি দেখার কারণে কি অটিজম হতে পারে?
উত্তর অতিরিক্ত স্ত্রিন টাইম শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সামাজিক দক্ষতা কমিয়ে দিতে পারে, তবে এটি সরাসরি অটিজমের কারণ নয়।
প্রশ্ন অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের কি বুদ্ধি কম থাকে?
উত্তর সব ক্ষেত্রে নয়। ৩৩-৪৫ শতাংশ শিশুর বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে, তবে অনেকে স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন বা অতি মেধাবীও হতে পারে।
প্রশ্ন অটিজম কি শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগের সমস্যা?
উত্তর না, ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে খিঁচুনি (এপিলেপসি), ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে অতি চঞ্চলতা (এডিএইচডি), বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যা এবং আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।
প্রশ্ন অটিজম কি শিশুর আয়ু কমিয়ে দেয়?
উত্তর কিছুটা সত্যি, কারণ দুর্ঘটনা (যেমন ডুবে যাওয়া) সহ বিদ্যমান রোগের কারণে মৃত্যুর হার সামান্য বেশি।
প্রশ্ন অটিজমের চিকিৎসায় অনেক ওষুধ লাগে, খরচ অনেক বেশি, তাহলে লাভ কী?
উত্তর অটিজমের চিকিৎসা লক্ষণভিত্তিক, মানে নির্দিষ্ট সমস্যার জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। যেমন – উদ্বেগ, অতি চঞ্চলতা, ঘুমের সমস্যা ও বিষণ্ণতা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া এল-কারনোসিন (L-Carnosine) গ্রহণ করলে স্নায়বিক কার্যকারিতা উন্নত হতে পারে।
প্রশ্ন বিকল্প ওষুধ ও থেরাপি খুব কার্যকর, অনেকেই সুস্থ হয়েছে- এটি কি সত্যি?
উত্তর কিছু থেরাপি সহায়ক হতে পারে, তবে সবগুলোর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা এখনও নিশ্চিত নয়।
প্রশ্ন সব ভেষজ ও বিকল্প থেরাপি কাজ করে কি?
উত্তর না, কিছু পদ্ধতিতে কোনও উপকারের প্রমাণ নেই, যেমন-সিক্রেটিন ও ফ্যাসিলিটেটেড কমিউনিকেশন কার্যকর নয়।
প্রশ্ন গ্লুটেনমুক্ত বা ক্যাসিনমুক্ত ডায়েট নিলে কি অটিজম ভালো হয়ে যায়?
উত্তর এটি কিছু ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে, তবে সবার জন্য কার্যকর নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা উচিত নয়।
প্রশ্ন কিছু নির্দিষ্ট থেরাপি ও ওষুধ নিশ্চিতভাবে কাজ করে কি?
উত্তর কিছু থেরাপি ও ভিটামিন উপকারী হতে পারে, যেমন– মিউজিক থেরাপি, অক্সিটোসিন, যোগব্যায়াম, সালফোরাফেন, ম্যাসাজ, মেলাটোনিন, ভিটামিন-সি, ভিটামিন-বি১২, ফোলিক অ্যাসিড।
প্রশ্ন স্টেম সেল থেরাপি, প্রোবায়োটিক্স বা অাকুপাংচার কি ১০০ শতাংশ কার্যকর?
উত্তর এসব পদ্ধতির কার্যকারিতা ও ঝুঁকি সম্পর্কে নিশ্চিত প্রমাণ নেই। তাই স্টেম সেল থেরাপি, ভেগাস নার্ভ স্টিমুলেশন, অডিটরি ইন্টিগ্রেশন থেরাপি, ক্যানাবিনয়েডস, প্রোবায়েটিক্স, আকুপাংচার, কায়রোপ্র্যাকটিক কেয়ার ইত্যাদি নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
প্রশ্ন বেশি মিষ্টি খেলে কি অটিজমের সমস্যা বাড়ে?
উত্তর কিছুটা সত্যি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অটিজমযুক্ত শিশুরা চিনি মেশানো পানীয় (SSB) বেশি খেলে আবেগজনিত সমস্যা বাড়তে পারে। অন্যদিকে, দুধ খাওয়া বাড়ালে সামাজিক আচরণ উন্নত হতে পারে। তাই চিনি মেশানো পানীয় কমিয়ে দুধের পরিমাণ বাড়ানো উচিত।
প্রশ্ন অটিজমের চিকিৎসার জন্য কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত?
উত্তর চাইল্ড বা পেডিয়াট্রিক নিউরোলজিস্ট এবং চাইল্ড সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।