- শিবশংকর সূত্রধর
পিয়ালি মাংসটা খুব ভালো রাঁধে। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের ওপর ঝাল-ঝাল করে কষিয়ে রান্না করা মাংসের ঝোলটা ঢালল রুদ্র। এক টুকরো লেবু চিপে মেখে নিল ভাতটা। খেতে খেতে জানলার বাইরে বৃষ্টিটা দেখছিল। কয়েকদিনের নাছোড়বান্দা বৃষ্টি। কখনও মুষলধারে, কখনও ঝিরিঝিরি। ‘আর দু’পিস মাংস দিই?’ বলল পিয়ালি। ‘হ্যাঁ, দাও।’ খেতে খেতেই জবাব রুদ্রর। রান্নাঘর থেকে মাংস এনে পাতে দিল পিয়ালি। সেখান থেকে এক টুকরো মাংস তুলে পিয়ালির দিকে এগিয়ে ধরে রুদ্র। আলতো হেসে পিয়ালি সেই টুকরোয় কামড় বসায়। বিয়ের দু’বছর পেরিয়েছে। এখনও প্রেম-পর্বটি বেশ তাজাই।
রুদ্রর মোবাইল বেজে ওঠে। ফোন করেছেন কোতোয়ালি থানার আইসি সুদীপ্ত ভট্টাচার্য। রুদ্র পেশায় একজন ক্রাইম রিপোর্টার। আইসি-র ফোন দেখে রুদ্র আন্দাজ করল নিশ্চয়ই কোনও খবরের সন্ধান মিলবে। ফোনটা রিসিভ করতেই আইসি বললেন, ‘ভালো খবর পেতে চাইলে সময় নষ্ট না করে এক্ষুনি বাসস্ট্যান্ডে চলে আসুন।’ খাবার ছেড়ে উঠে পড়ে রুদ্র। অভিমানের সুরে পিয়ালি বলে, ‘পুরোটা খেয়ে গেলে কি খুব দেরি হত?’ পিয়ালির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রুদ্র বলে, ‘একদম সময় নেই। মনে হচ্ছে বড় কোনও খবর আছে।’
বাসস্ট্যান্ডের উলটো দিকে চায়ের দোকানটায় ঢোকে রুদ্র। বৃষ্টিতে রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। দোকানে রাখা বেঞ্চে কয়েকজন বসে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজনকে কীরকম যেন দেখতে! লম্বা দাড়ি। গামছা দিয়ে মাথায় পাগড়ির মতো বাঁধা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। হাঁ করে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। রুদ্র একটি সিগারেট ধরিয়ে আইসি-র নম্বরে ডায়াল করল। রিং হল। রিসিভ হল না। মিনিট দশেক পর রুদ্র আবার ফোন করে। এবারেও তাই। বিরক্তই হচ্ছে রুদ্র। বৌয়ের হাতের কষা মাংস ফেলে এসে বৃষ্টি-বাদলার মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে কারও!
বাসস্ট্যান্ডে এনবিএসটিসি-র একটি বাস এসে ঢুকল। চায়ের দোকানের নিস্তব্ধতা ভাঙে। গামছা দিয়ে পাগড়ির মতো করে পরা লোকটা রুদ্রর কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘তৈরি হয়ে নিন। এখনই কাজ শুরু হবে।’ চমকে ওঠে রুদ্র। আরে! ইনিই তো আইসি। ছদ্মবেশে এখানে বসে রয়েছেন কেন! তবে পুলিশের ছদ্মবেশ ধারণ দেখে রুদ্র বুঝে গিয়েছে, এখন বেশ রোমাঞ্চকর কিছু একটা হবে। উত্তরবঙ্গজুড়ে প্রচুর মাফিয়া গ্যাং রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ধরার সময় পুলিশ খদ্দের সেজে হানা দেয়। হাতের নাগালে পেলেই পাকড়াও। আজ হয়তো তেমন কিছুই ঘটবে। একটু আড়ালে গিয়ে রুদ্র ফিশফিশ করে আইসি-কে বলে, ‘ঘটনাটা কী একটু বলবেন।’
‘কিছুক্ষণ আগে আলিপুরদুয়ারের একটি বাস এসেছে খেয়াল করেছেন?’
‘হ্যাঁ, দেখলাম তো। ওই তো ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘ওই বাসেই আছে ক্রিমিন্যাল। রাজাভাতখাওয়া থেকে একটি প্যাকেট নিয়ে এসেছে। এখানে হাতবদল হবে। পাক্কা খবর আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে একটি বাইক আসবে। তখন প্যাকেটটি হাতবদলের সময় ব্যাটাদের ধরব। বাসস্ট্যান্ডে আমাদের প্রচুর পুলিশ ছদ্মবেশে রয়েছে। সিগন্যাল পেলেই সব ঝাঁপিয়ে পড়বে।’
রুদ্র বলল, ‘ওই প্যাকেটে কী আছে?’
‘হাতির দাঁতের টুকরো।’
রুদ্র ইতিমধ্যেই চমকে উঠেছে। এগারো বছরের সাংবাদিকতার জীবনে পুলিশের অনেক রেইডের ঘটনা সে দেখেছে। তবে হাতির দাঁতের টুকরো পাচারের কোনও ঘটনার সাক্ষী থাকেনি।
বাসস্ট্যান্ডের সামনে একটি ফলের দোকানের পাশে বাইকটি এসে দাঁড়াল। দুজন কমবয়সি ছেলে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে সুদীপ্ত ভট্টাচার্যের। বাস থেকে নেমে আসছে ছেলেটি। হাতে খয়েরি রংয়ের ছোট ব্যাগ। ওদিকে বাইক স্টার্ট দেওয়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। আইসি বুঝতে পারলেন, হাতে সময় মাত্র কয়েক সেকেন্ড। এরমধ্যে ধরতে না পারলে বাইক নিয়ে পালিয়ে যাবে ক্রিমিন্যালরা। কোমরে গোঁজা রিভলভারটি ভালো করে গুঁজে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।
রুদ্র পকেট থেকে মোবাইল বের করে হাতে রাখে। অপারেশন শুরু হলেই দ্রুত সব ছবি তুলে নিতে হবে। বাস থেকে নেমে আসা ছেলেটি বাইকের সামনে গিয়ে ব্যাগটি হাতবদল করতেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন আইসি। ততক্ষণে চারপাশে থাকা কয়েকজন ছদ্মবেশী পুলিশ ছুটে এসেছে। সবকিছু চলছিল পরিকল্পনামাফিক। কিন্তু হঠাৎই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। আইসির মূল নজর ছিল বাইকে বসা ছেলেটির ওপর। কারণ ওই মুহূর্তে তার হাতেই ছিল হাতির দাঁতের টুকরোটি। কিন্তু যে ক্রিমিন্যাল বাস থেকে নেমে এসেছিল সে হঠাৎই পকেট থেকে পিস্তল বের করে ফেলে। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলি দেখে আশপাশের লোকজন ততক্ষণে ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। সেই সুযোগে রাস্তা থেকে ছোট্ট একটি ছেলেকে কোলে তুলে নেয় পিস্তল হাতে থাকা ক্রিমিন্যালটি!
চিৎকার করে পুলিশকে বলে, ‘চুপচাপ এখান থেকে না সরলে বাচ্চাকে খালাস করে দেব।’ পাচারকারীদের ধরার চাইতেও ছোট্ট বাচ্চাটির প্রাণের দাম অনেক বেশি। আইসি বললেন, ‘তোমরা ওর কোনও ক্ষতি করবে না। ছেড়ে দাও। তুমি একটা গুলি চালালে তোমাদের তিনজনকেই আমরা একেবারে ঝাঁঝরা করে দেব।’ এবার বাচ্চাটির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ক্রিমিন্যাল বলে, ‘মরার ভয় করলে এই লাইনে আসতাম না। এখান থেকে যেতে না দিলে বাচ্চার মাথায় গুলি ভরে দেব।’ আইসি বুঝতে পারলেন, অবস্থা বেগতিক দিকে যাচ্ছে। ক্রিমিন্যাল যদি বাচ্চাটিকে গুলি করে দেয় তাহলে উপরমহলে তাঁকে ভীষণ চাপে পড়তে হবে। মিডিয়ার ভয় তো আছেই। তাই তিনি মনে মনে ফন্দি আঁটেন। ভাবলেন, ওরা যখন বাইক নিয়ে পালাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে চাকায় গুলি করবেন।
পুলিশকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন আইসি। নিজেও সরে এলেন। বাইট স্টার্ট হল। বাচ্চাটির মাথায় পিস্তল ধরে রাখা অবস্থাতেই ওই ক্রিমিন্যাল বাইকের সামনে এগিয়ে যায়। পুলিশ নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতেই তৃতীয়জন বাইকে উঠে বসে। বাচ্চাটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেই ফুল স্পিডে বাইক এগিয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে এক রাউন্ড গুলি চালান আইসি। লাভ হল না। ফুল স্পিডে আঁকাবাঁকাভাবে এগিয়ে পালিয়ে গেল ক্রিমিন্যালরা। যাওয়ার সময় বাইকের পেছন সিট থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে তারাও দুই রাউন্ড গুলি ছোড়ে। দূর থেকে সব মোবাইলবন্দি করে নেয় রুদ্র।
পরদিন সকালে খবরের কাগজ হাতে নিতেই লজ্জা, অপমানে মাথা নীচু হয়ে গেল আইসির। নিজেদের ব্যর্থতার খবর দেখে অপমানিত বোধ করলেন। গতকাল নিজেই যখন রিপোর্টার রুদ্রকে ফোন করে অপারেশনে ডেকেছিলেন তখন আইসি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত ছিলেন, মিশন সাকসেসফুল হবেই। কিন্তু হল না।
সন্ধের দিকে অন্য একটি খবরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল রুদ্র। অফিসে চার্জে বসানো মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল আলিপুরদুয়ারের এক সোর্সের নাম। সোর্স হল তারা, যারা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে রিপোর্টারদের নানারকম খবর দেয়। ফোনের ওপারের কণ্ঠে ভেসে ওঠে, ‘কেমন আছেন রিপোর্টার দাদা? একটা ইনফরমেশন দেওয়ার আছে।’ উৎসাহী গলায় রুদ্র বলল, ‘হ্যাঁ, বলুন। কী ইনফরমেশন?’
‘আপনার একটি খবর পড়েছি, তিনজন ক্রিমিন্যাল হাতির দাঁতের টুকরো নিয়ে পালিয়ে গেছে। ওরা এখন কোথায় আছে আমি তা জানি।’
‘কোথায় আছে ওরা!’
‘একটু আগে আমার দোকানে ওদের দুজন চা খেতে আসে। দেখেই খটকা লাগছিল। ওরা চলে যাওয়ার পর পেপার বের করে ছবি মিলিয়ে দেখেছি। এরা যে ওই ক্রিমিন্যালরাই তা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।’
‘চা খেয়ে কোথায় গেল খেয়াল করেননি?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি। আমার দোকানের সামনেই একটি রিসর্টে ঢুকতে দেখেছি।’
‘ঠিক আছে আমি দেখছি কী করা যায়। আপনি ওদের উপর নজর রাখবেন। কিছু দেখলে জানাবেন প্লিজ।’
‘নিশ্চয়ই। এই চাওয়ালার উপর নিশ্চিন্তে ভরসা রাখুন।’
ইনফরমেশনটা আইসিকে জানাল রুদ্র। আইসি বললেন, ‘আপনি শিওর ওরা রাজাভাতখাওয়ায় আছে?’
‘হ্যাঁ শিওর। আমার সোর্সের ইনফরমেশন ভুল হবে না।’
‘ঠিক আছে। আমরা এখনই রওনা দেব। যাবেন নাকি আপনিও? আগেরবার তো মিশন সাকসেসফুল হল না। এবার নিশ্চয়ই হবে।’
হাতির দাঁত পাচারকারীদের চোখের সামনে কুপোকাত করার দৃশ্য দেখার লোভ সামলাতে পারল না রুদ্র। প্রস্তাবে সায় দিল। রাত ৮টা নাগাদ ওরা রাজাভাতখাওয়ায় পৌঁছায়। এদিকটায় অনেক হোমস্টে, রিসর্ট, বনবাংলো রয়েছে। বাইরের পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। রুদ্ররা সেই চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। এখান থেকে রিসর্টটি পুরোটা দেখা যায়। পেশাদার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চাওয়ালা তাঁর মোবাইল বের করে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করলেন রুদ্রকে, ‘কিছুক্ষণ আগেই ওই দুজন রিসর্ট থেকে বেরিয়ে আলিপুরদুয়ারের দিকে গেছে। এখনও ঢুকতে দেখিনি।’
তাহলে কি শিকার পালিয়ে গেল? বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে রুদ্রর।
অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ঝড়-বাদলের রাতে ছোট্ট চায়ের দোকানে কয়েকজন গাদাগাদি করে বসে শিকারের অপেক্ষা করছে। বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে গায়ে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। আলিপুরদুয়ারের দিক থেকে ১০-১৫ মিনিট পর বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে একটি অটো এসে দাঁড়ায় রিসর্টের সামনে! রুদ্ররা সতর্ক। হয়তো শিকার চলে এসেছে। আড়চোখে নজর রাখছে পুলিশ। দুজনকে দেখা গেল অটো থেকে নেমে বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে ভিতরে ঢুকে গেল। এরাই যে ওই ক্রিমিন্যাল তা বুঝতে বাকি থাকল না। আইসি-র পুরো টিম হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লেন রিসর্টে। রয়েছে লোকাল পুলিশও।
প্রতিটি ঘরে সার্চ চলছে। রিসর্টজুড়ে হুলুস্থুল কাণ্ড। একটি ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। বারবার ডেকেও সাড়া মিলছে না। মিনিটখানেক অপেক্ষার পরও সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে পুলিশ। কিন্তু এ কী! ঘরে কেউ-ই নেই! পেছনের জানলাটি খোলা। তাহলে কি জানলা দিয়ে শিকার পালিয়েছে? সবদিকেই নজর রাখছিল রুদ্র। নজর গেল ঘরের অ্যাটাচ বাথরুমের দিকে। মেঝেতে কিছুটা বৃষ্টির জলের ছাপ। সেগুলি গিয়েছে বাথরুমের দিকে। তাহলে কি জানলা খোলা রেখে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ক্রিমিন্যালরা বাথরুমে লুকিয়েছে? রুদ্র দরজাটা একটু ঠেলতেই বোঝা গেল, ভিতর থেকে বন্ধ! কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়েও লাভ না হওয়ায় পুলিশ দরজা ভাঙে। ভিতরেই ভয়ার্ত চোখে দাঁড়িয়ে ওই তিনজন, যারা বাসস্ট্যান্ডের সামনে গুলি করে পালিয়েছিল। পুলিশ টেনেহিঁচড়ে বার করে বাথরুমের ভেতর থেকে। কিছুক্ষণ পুলিশের থার্ড ডিগ্রিও চালানো হলেও মুখ খুলল না তারা। হাতির দাঁতের সন্ধান মিলছে না কিছুতেই। আইসি ক্রিমিন্যালদের একজনের কপালে রিভলভার ঠেকাতে শেষপর্যন্ত রণে ভঙ্গ দেয় তারা।
কপালে রিভলভারের ঠান্ডা ছোঁয়া পাওয়ার পর সেই ক্রিমিন্যাল বলল, ‘ওটা আমাদের কাছে নেই। পান্ডে স্যরের কাছে আছে।’
আইসি বললেন, ‘কোন পান্ডে স্যর? কোথায় আছে সে?’
‘স্যর, ছেড়ে দিন স্যর। ওনার কথা বললে উনি আমাদের মেরে ফেলবে।’
‘আর না বললে আমি এখনই তোকে মেরে ফেলব।’
ক্রিমিন্যালের পেটে একটি ঘুসি বসিয়ে দিলেন আইসি। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে সে বলা শুরু করল। ‘পান্ডে স্যর আমাদের হাতির দাঁতের টুকরোটি দিয়েছিলেন। আলিপুরদুয়ার থেকে সেটা কোচবিহার হয়ে শিলিগুড়িতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল আমাদের। সেখান থেকে অন্য একজনের মাধ্যমে নেপালে যেত। কিন্তু কোচবিহারে গণ্ডগোল হওয়ায় প্ল্যান চেঞ্জ হল। পান্ডে স্যর বললেন, এখন ওটা নেপালে পাঠানোর দরকার নেই। আমাদের ছবি পেপারে বেরিয়েছে। ওটা আমাদের কাছে থাকা নিরাপদ নয়। সেজন্য কিছুক্ষণ আগেই পান্ডে স্যরের বাংলোতে ওটা দিয়ে এসেছি।’
আইসি বললেন, ‘কে তোদের পান্ডে স্যর? ঠিকানা বল। এখনই যাব ওখানে।’
-‘এখান থেকে মিনিট দশেক অটোতে গেলেই পান্ডে স্যরের বাংলো। তিনি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একজন অফিসার।’
শেষ লাইনটি শুনে ঘরে থাকা সবাই চমকে ওঠে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ভিতরেই তাহলে ঘুঘুর বাসা। রক্ষকই যদি ভক্ষক হন তাহলে দুনিয়া বাঁচবে কীভাবে!
কাঠের তৈরি দোতলা বাংলোটিতেই থাকেন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসার প্রদ্যুৎ পান্ডে। সেখানে পৌঁছাল পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে তাঁর শাগরেদদের দেখে পান্ডের তখন ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে?’ আইসি বললেন, ‘আমাদের কাছে খবর আছে আপনি হাতির দাঁত পাচার করছিলেন। তার একটি টুকরো আপনার কাছেই আছে। বের করুন।’
‘কী বলছেন এসব। কীসের হাতির দাঁত! আমি কিছু জানি না।’
‘ওরা কিন্তু সবকিছু স্বীকার করে নিয়েছে। আপনি যদি তদন্তে সহযোগিতা না করেন তাহলে আমাদের কাছ থেকে আর ভদ্রতা আশা করবেন না।’
পান্ডে ভেবেছিলেন, তিনি বড় অফিসার হওয়ায় কেউ তাঁর নাগাল পাবে না। চোরাশিকারিদের দিয়ে হাতি মেরে দেহের অংশগুলি বিদেশে পাচার করে দিচ্ছিলেন। শেষরক্ষা হল না। কাঁপা কাঁপা হাতে লকার থেকে একটি বাক্স বের করে মেহগনি কাঠের টেবিলটায় রাখলেন। বাক্স থেকে বের করলেন লাল কাপড়ে মোড়া হাতির দাঁতের টুকরোটি। সেটি বাজেয়াপ্ত করল পুলিশ। প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ রওনা দেয়।
ইতিমধ্যে রুদ্র তার অফিসে বিস্তারিত জানিয়েছে। উত্তরবঙ্গ থেকে বিদেশে হাতির দাঁত পাচারের পর্দাফাঁস। গ্রেপ্তার হলেন বন দপ্তরের অফিসার সহ তিন শাগরেদ। রুদ্র এক্সক্লুসিভ সেই খবরটি মোবাইলেই লিখে অফিসে পাঠায়। পরদিন প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় খবরটি।
পুলিশ হোক বা সাংবাদিক। তাঁদের প্রচুর সোর্স থাকে। আড়ালে থেকে তাঁরা সমাজের অপরাধ দমনের জন্য কাজ করে চলেন। কিন্তু কখনও প্রচারের আলোয় আসেন না। যেমন, ওই চায়ের দোকানদার। অবশ্য তাঁদের প্রকাশ্যে না আসাই স্বাভাবিক। জীবনের ঝুঁকি বলেও তো একটি কথা আছে।