- অরিন্দম ঘোষ
বাংলায় ‘সোনার-সংসার’ বলে একটা শব্দবন্ধ আছে। এই সোনার সংসার মানে কী? অনভিজ্ঞ লোকেরা বলবেন, যে সংসারে সবকিছুই পারফেক্ট থাকে, কোনও যুদ্ধ নেই, সেটাই সোনার সংসার। কিন্তু সংসার সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকেরা বলে থাকেন, যে সংসারে ঝগড়া নেই, অশান্তি নেই, যুদ্ধ নেই, সেটা আবার সংসার নাকি? সে তো একেবারে পানসে একটা ব্যাপার। নিত্য অশান্তি ঝগড়া আর যুদ্ধ হলে তবেই তা সত্যিকারের সোনার সংসার।
সংসারের যুদ্ধের দুটি মূল চরিত্র স্বামী-স্ত্রী। তবে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগে। বিয়ের প্রথম বছরে স্বামী বলেন, স্ত্রী শোনেন। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে স্ত্রী বলেন, স্বামী শোনেন। বিয়ের তৃতীয় বছরে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বলেন, প্রতিবেশীরা শোনেন। এইভাবে ধাপে ধাপে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
আমার পরিচিত এক দম্পতির কথা বলি। ওঁদের সংসারে রোজ ঝগড়া হয়। স্বামী সকালে অফিসে বেরিয়ে যান, অফিসে তাঁর বস অত্যন্ত কড়া, পান থেকে চুন খসলেই ঝাড় খেতে হয়। ফলে স্বামীর মেজাজ হয়ে যায় খিটখিটে। বসের ওপর তো আর রাগ ঝাড়া যায় না, ফলে বাড়ি ফিরে স্ত্রীর ওপরেই অকারণ সেই রাগ গিয়ে পড়ে। অফিস থেকে ফিরলেই কিছু না কিছু নিয়ে ঝগড়া হবেই। ঝগড়ার কোনও স্পেসিফিক কারণ থাকে না, কিন্তু চিৎকার-চ্যাঁচামেচিতে প্রতিবেশীরা অতিষ্ঠ হয়ে থাকেন রোজ।
একদিন কোনও কারণে অফিসে বস ঝাড় দেননি, অফিস থেকে বাড়ি ফিরেও স্বামীর মেজাজ বেশ ফুরফুরে। সেদিন বহুক্ষণ পরিবেশ শান্ত দেখে এক কৌতূহলী প্রতিবেশী দরজায় নক করে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, আপনার স্বামী কি আজ অফিস থেকে বাড়ি ফেরেননি?
সোনার সংসার অনেকটা এইরকম। ঝগড়া, অশান্তি, যুদ্ধ বেশি হওয়াও ভালো নয়, আবার একটু-আধটু ঝগড়া না হলেও কেমন কেমন লাগে। তবে এ সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই যে যুদ্ধ আছে, তা তো নয়, জ্ঞানীমাত্রই জানে, আরেকটি পপুলার ক্যাটিগোরি হল বৌমা আর শাশুড়ির যুদ্ধ। এক সদ্যবিবাহিত বধূকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল শাশুড়ি শব্দের অর্থ। বধূটির উত্তর ছিল, সুর করে শাসায় যে বুড়ি, সে-ই হল শাশুড়ি। কথাটি শাশুড়ির কানে যেতেই ব্যাস কথাবার্তা বন্ধ। তবে বধূটিকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। শুনেছি শাশুড়িটিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন? শাশুড়ির উত্তর ছিল, আগে করতাম না এখন করি, বিয়ের পর থেকেই আমার ছেলে সারাক্ষণ ভূতের মতো আমার বৌমার পিছনে ঘুরঘুর করে।
আসলে সাংসারিক যুদ্ধ অনেকটা সিনেমার মতো। মাঝে মাঝে যখন সংসারে তুমুল অশান্তি বাঁধে, প্রায় যুদ্ধের পরিস্থিতি হয় তখন অ্যাকশন সিনেমা, কখনও এত হাসাহাসি আনন্দ উপচে পড়ে তখন কমেডি, আর কখনও পরিস্থিতি থাকে এই অ্যাকশন আর কমেডির মাঝখানে, মানে কখন কী হয়ে যায় বলা যায় না, তখন সেটা থ্রিলার।
তাই বলা যায়, সংসারের যুদ্ধ এমন এক রঙ্গমঞ্চ, যেখানে হাসি-কান্না, প্রেম-অভিমান সবই একাকার। তবে সব যুদ্ধের যেমন প্রকারভেদ থাকে, সাংসারিক যুদ্ধেরও ভিন্নতা আছে। যেমন, টিভির রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে যুদ্ধ। এই যুদ্ধটা যেন অলিখিত সংবিধানের প্রথম ধারা। কার হাতে টিভির রিমোট থাকবে, তা নিয়ে রোজ সন্ধ্যায় জল কম ঘোলা হয় না। স্বামী চান ক্রিকেট বা খবর, আর স্ত্রী হয়তো সিরিয়াল। কিছুতেই এই যুদ্ধের রফা হওয়া সম্ভব হয় না। শেষপর্যন্ত দেখা যায় হয়তো যুদ্ধবিরতি হয় কোনও কার্টুন চ্যানেলে।
সংসারের আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র হল আলমারি। স্ত্রীর দাবি, তার শাড়ির সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য আরও জায়গা চাই। স্বামীর বক্তব্য, তার অতি প্রয়োজনীয় (আসলে বহু বছর ধরে পরা হয় না এমন) পোশাকগুলো রাখারও স্থান সংকুলান করতে হবে। এই যুদ্ধে প্রায়শই ‘সীমান্ত’ পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজন পড়ে। তবে এই যুদ্ধে স্ত্রীর জয় অবশ্যম্ভাবী।
সংসারের আরেকটি রণক্ষেত্র হল রান্নাঘর। যদিও অধিকাংশ সংসারে রান্নাঘরের কর্তৃত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাকে স্ত্রীর দখলেই। কিন্তু কার পছন্দের মেনু কোনদিন চলবে, কোন মশলা কতটা পড়বে, এই নিয়ে প্রায়ই ঠান্ডা যুদ্ধ লেগে থাকে। শাশুড়ি মায়ের ঐতিহ্যবাহী রান্না বনাম পুত্রবধূর আধুনিক ফিউশন- এই দ্বৈরথে মাঝে মাঝে এমন সব অদ্ভুত পদ সৃষ্টি হয়, যা স্বাদে অতুলনীয় না হলেও আলোচনায় ঝড় তোলে।
যুদ্ধে শান্তি যেমন বিনষ্ট হয় তেমনি সাংসারিক যুদ্ধে বিনষ্ট হতে পারে ছুটির দিনের সকালের আরামের ঘুম। শান্তির রাজ্যে হানা দেয় ‘এই ওঠো, বাজার যেতে হবে’ মার্কা গ্রেনেড। স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে কার আগে ঘুম ভাঙবে আর কার পরে, তা নিয়ে নীরব প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। অন্যদিকে যুদ্ধ থাকলে অভিযান থাকবেই, তাই সংসারের সবচেয়ে বড় যৌথ অভিযান হল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যুদ্ধ। স্ত্রীর হাতে ঝাড়ু আর স্বামীর হাতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। তবে যুদ্ধটা বাধে তখন, যখন ‘এটা এখানে কেন?’ অথবা ‘ওটা ওখানে কে রেখেছে?’ মার্কা অভিযোগের তির যখন ছোড়া হয়।
মাসের শেষে যখন খরচের খাতা খোলা হয়, তখন যেন কুরুক্ষেত্র বাঁধে! ‘এই টাকাটা কোথায় গেল?’ থেকে শুরু করে ‘এত খরচ কেন?’- এই জাতীয় প্রশ্নবাণ উভয় দিক থেকেই ধেয়ে আসে। শেষপর্যন্ত হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভবিষ্যতের জন্য বাজেট নিয়ন্ত্রণের প্রতিজ্ঞা করে যুদ্ধ শেষের ঘোষণা হয়। তেতো হলেও সত্যি, আত্মীয়স্বজনের আগমন যেন হঠাৎ করে বেজে ওঠা যুদ্ধের দামামা। ঘর গোছানো থেকে শুরু করে খাবার বানানো পর্যন্ত- সবকিছুতেই একটা চাপা উত্তেজনা থাকে। তবে আসল যুদ্ধটা বাধে অতিথি বিদায়ের পর। যখন ‘ওঁরা এটা বললেন কেন’ অথবা ‘তাঁদের ওটা ভালো লাগেনি’ মার্কা আলোচনা শুরু হয়।
তবে সবমিলিয়ে উপলব্ধি হল, সংসারের এই যুদ্ধগুলো আসলে ভালোবাসারই অন্য রূপ। ছোটখাটো খুনশুটি আর মান-অভিমানের মধ্যে দিয়েই তো একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই যুদ্ধগুলো না থাকলে সোনার সংসারকে আসলে রুপোর সংসার লাগত।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি কতদিন স্থায়ী হবে এই মুহূর্তে বলা শক্ত, তবে এটা বলা যায়, সংসারের যুদ্ধ, অশান্তি, ঝগড়ার কোনও শেষ নেই, তা চলবে আজীবন। এ যেন সব মিছিলের সেই কমন স্লোগানের মতো- চলছে, চলবে।