সোনার জুটিতে লুটি

সোনার জুটিতে লুটি

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  • অলক রায়চৌধুরী

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত নির্মলা মিশ্র স্বচক্ষে দেখলেন কিংবদন্তি গায়ক বেচু দত্তর গান কেউ শুনতে চাইছেন না। শিল্পীর এই অপমান সহ্য হয়নি নির্মলাদির। বেদনার্ত হৃদয়ে লিখে ফেললেন কয়েকটি পংক্তি ‘যেদিন আমার গান ফুরাবে সবাই সেদিন ভুলবে মোরে /ব্যথায় ভরা দিনগুলি মোর কাটবে সেদিন কেমন করে?’

লেখা নিয়ে নচিকেতা ঘোষের বাড়িতে গিয়ে দেখেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার হাজির সেখানে। নির্মলাদির কাছে ঘটনা জেনে এবং সেই চার লাইনের কবিতা ধরে গৌরীপ্রসন্ন লিখে ফেললেন অবিস্মরণীয়  বেসিক গানখানি, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’। সুর বসালেন নচিকেতা। শুধু নির্মলা মিশ্রকে দিয়েই নয়, প্রতিবেশী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে দিয়েও বারবার গাওয়ালেন সে গান। তারপরে দরবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছে। এ  তো গেল বেসিক গানের কথা। ছায়াছবির গানে শতবর্ষের এই  গৌরী-নচিকেতা জুটি কয়েক দশক জুড়ে কতটা  সাড়া জাগিয়েছেন, একবার দেখে নেওয়া যাক তা।

১৯৫৩ থেকে ১৯৮৪, একত্রিশ বছরে পঞ্চাশটির মতো বাংলা  ছবিতে একত্রে কাজ করেছে এই জুটি। সংখ্যায় তো বটেই, গুণমানেও ছবির গানে আর কোনও জুটি এই কলাকৃতিকে  টেক্কা দিতে পারেননি। সেখানে বড় অস্ত্র বৈচিত্র্য। সবচেয়ে বড় কথা, সুর এবং কথার নির্মাণ অনেক সময়েই যে একসঙ্গে বসে হয়েছে, গান শুনলেই বোঝা যায় তা। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় লিখেছেন সৃষ্টিশীল আড্ডার সেইসব দিবসরজনীর কথা।

গৌরীবাবু সর্বদা জুড়ে থাকতেন নচিকেতার সঙ্গে। এই প্রতিবেদকের মনে আছে, নীতা সেনের বাড়িতে বসে একবার স্মৃতিচারণও করেছিলেন সেই সময়ের। উত্তমকুমারের লিপে  মান্নাবাবুর গান, কথা আর সুরের সারথি গৌরীপ্রসন্ন এবং নচিকেতা। কেউ কাউকে একচুল ছাড়তেন না, যতক্ষণ না পারফেক্ট হচ্ছে সবকিছু। ঝগড়াও বেঁধেছে সে কারণে। সন্ন্যাসী রাজার গান নিয়ে ওঁদের ভাবনায় উত্তমকুমারের অংশগ্রহণ, অভিনয়ে গানে প্রাণ কীভাবে আসবে, তা দেখতে স্টুডিও সেটে হাজির হয়ে যেতেন নচিকেতা। শরীরের ডাক্তার তখন গানের সার্জন। ডাক্তারি ছেড়ে গান ধরেছেন নচিকেতা, সাথি গৌরীপ্রসন্ন।

 ছবির সেই সব গান এক কলি করে লিখলেই আর কিছু লেখার দরকার পড়ে না। বরং কয়েকটি ছবির নামোল্লেখ করা যাক। অর্ধাঙ্গিনী, ত্রিযামা, ভানু পেলো লটারি, ইন্দ্রাণী, চাওয়া পাওয়া, পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট, ক্ষুধা, ছোট্ট জিজ্ঞাসা, চিরদিনের, শেষ থেকে শুরু, বিলম্বিত লয়, নিশিপদ্ম, ধন্যি মেয়ে, ফরিয়াদ, স্ত্রী, মৌচাক, কাজললতা, স্বয়ংসিদ্ধা, সন্ন্যাসী রাজা…. এ তালিকা আর বাড়িয়ে লাভ নেই। কী পরিমাণ মেধা আর মনন থাকলে এতগুলি ছবিতে নিজেদের নাম সিলমোহরের মতো প্রোজ্জ্বল  রাখা যায়, দেখিয়ে দিয়েছেন ওঁরা। ইন্দ্রাণী ছবি হিসেবে আহামরি হয়নি, দর্শক আনুকূল্য পায়নি, কিন্তু গান সুপারহিট। ছবির বাইরে আলাদা করে গান মনে রাখতে বাধ্য করেছেন যুগল স্রষ্টা, এ বড় কম কথা নয়।

নিরীক্ষাগুলিও অসামান্য। ’৬৯-এর ‘চিরদিনের’ ছবির কথাই ধরা যাক। ‘তুমি আমার চিরদিনের‘, ‘মানুষ খুন হলে পরে’, ‘ফুল পাখি বন্ধু আমার ছিল’, ‘লাল নীল সবুজেরই মেলা বসেছে’,– চার গোত্রের চারটি গান। মানুষ খুন-এ  ভজনের তন্ময়তা যেমন আশ্চর্য কুশলতায় ধরেছেন, ‘ফুল পাখি’-তে কীর্তনের মেজাজ সতর্ক শ্রোতার কান এড়ায় না। ‘তুমি আমার চিরদিনের’ বা ‘লাল নীল সবুজেরই’-তে কাব্যগীতিতে অবগাহন, শরীরে যার সাগরপারের সুরস্থাপত্য। সে শরীর থেকে গৌরীপ্রসন্ন বা নচিকেতাকে আলাদা করা যায় না।

ছায়াছবির গল্পের ভেতরেই অবিচ্ছেদ্য হয়ে  রয়ে যান তাঁরা। সন্ন্যাসী রাজা-য় (১৯৭৫) ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’ সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গে ঘাটে মাঠের জলসায় অটোমেটিক চয়েস ছিল প্রকাশকামী শিল্পীর কণ্ঠে। গাইতেই হবে। এমন দু’-চারখানি গান গাওয়ার জন্য ডজন খানেক মান্নাকণ্ঠী কপি সিংগার তৈরি হয়ে গেল।

রেডিওতে নাম বলে না, অনুষ্ঠানে শিল্পীরাও জানাতেন না কাদের সুর বা কথায় তাঁদের কণ্ঠে লালিত হয়েছে এই গান– কিন্তু সুররসিক জেনে যান ‘আমার পদ্মপাতায় পাঁক লাগে না, কলঙ্ক  পাঁক যতই ঘাঁটি’-তে মান্নাবাবু কণ্ঠ দিয়েছেন গৌরীপ্রসন্ন, নচিকেতার সাজানো বাগিচায়, যার তালাধ্যায়ে আছেন রাধুবাবু, রাধাকান্ত নন্দী। সরকারি বেসরকারি পুরস্কার বা স্বীকৃতির তোয়াক্কা না করেই এই সৃজন, ওঁদের জন্মের শতবর্ষে মানুষ একচুলও ভুলল না। ভুলবে কী করে? সুধীন দাশগুপ্ত আর নচিকেতা ঘোষ সার বুঝেছিলেন, লোকসুর দিয়ে শ্রোতার মনে ঢুকতে হবে আগে। ‘আমি আঙুল কাটিয়া’ থেকে শুরু করে ‘মালতী ভ্রমরে’, ‘পাগলা গারদ কোথায় আছে’– ইত্যাদি মনোরঞ্জক সুরে সাধারণ শ্রোতাকে মুঠিবদ্ধ করে নিয়েছেন ওঁরা লোকসুরের প্রশ্রয়ে। কথা জোগাচ্ছেন যিনি, তাঁর কৃতিত্ব কম কী? একের পর এক ছবি সেই কৃৎকৌশলেই উতরে গিয়েছে। এর থেকে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে!  সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, পরিচালকদের প্রশ্রয়ও পেয়েছে এই জুটি। গানের গর্ব তাই চারিয়ে গিয়েছে ছবির শাখা প্রশাখায়, প্রক্ষিপ্ত মনে হয়নি ছবির মূল সুরের সঙ্গে।

ছবির গানের বাইরে আছে বেসিক গান। ছবিতে অনেক ফরমাশ আর বাধ্যবাধকতা থাকে। দেখার বিষয়টা মাথায় রাখতে হয়। বেসিক গানে সেটা নেই। সেখানেও আশ্চর্য সব বুটিক  ফুল ফুটিয়েছে এই জুটি। ‘আমার গানের স্বরলিপি’ সুর ও বাণীর গৌরবে রেকর্ড প্রকাশের সময়ে তুলনায় অন্তত একশো বছর এগিয়ে ছিল। কলকাতায় হেমন্তবাবু এলে গান নিয়ে বসা, যার প্রতি সেশনে গৌরীপ্রসন্ন উপস্থিত থাকতেন। সেই আন্তরিকতা আর মেধার মিলন তাই জনপ্রিয়তার শিখরে, আজও। আজও যে কোনও গাইয়ের কাছে  স্বপ্নের কলি, ‘আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোনো, আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’। আরও আছে। আছে ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’- র তেওড়ায় বাঁশির সুরে গমন, ‘প্রজাপতি মন আমার’-এ রাগ ছেনে নবরাগ প্রতিষ্ঠার কৌশল, ‘বেশ তো না হয় সপ্তঋষির’-এ আশ্চর্য কাব্যময়তায় সুরস্নান, ‘যদি কাঁদতে পারতাম’-এ  কাওয়ালির চতুর রস, ‘আমার সাদা রংটা নাও’-এর নীরব আর্তি, ‘ওগো বর্ষা তুমি’-র সেতারের ছন্দ ভাঙা শ্রাবণগীতি। উদাহরণ তো ভূরিভূরি। গৌরীপ্রসন্ন আর নচিকেতা উজাড় করে দিয়েছেন তাঁদের সবটুকু। সেই ধন নিয়ে বাঙালি আরও একশো বছর নিশ্চয়ই গর্ব করবে।

এবং এই লেখাটি পড়ার পরপরই শ্রোতার তরফে অবধারিত প্রশ্ন : এই এই গান আলোচনায় থাকল না কেন? এই ছবির কথাও তো আসেনি। এজন্যই এঁরা শতবর্ষে প্রণম্য। সব বলা বা লেখা হয়ে গেলে, সব পরিমাপ সাঙ্গ হলে, আজ রবিবারের পাতায় সমারোহে তাঁদের স্মরণ করা হত কি? লিখেছেন, সুর করেছেন যত, তার থেকে বহুগুণ বেশি ভাবিয়েছেন শ্রোতাদের। সেই ভাবনায় ভর করে আধুনিক বাংলা গান আর ছায়াছবির গানের দিব্য সহজগতি যুগ থেকে যুগান্তরে। কোনও রিমিক্স-রিমেকের তোয়াক্কা করে না সে। কারণ গৌরীপ্রসন্ন, নচিকেতারা মানুষের সহজ ভালোবাসা, হাসি, কান্না, অভিমান, অনুরাগকে মানবিক  চেতনার ভিয়েনে বসিয়ে পরিবেশন করেছেন, আবেগকে যন্ত্রের কাছে পরাস্ত হতে দেননি। সেখানেই ওঁদের জিৎ।

The put up সোনার জুটিতে লুটি appeared first on Uttarbanga Sambad.



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *