- শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়
প্রকাশদার ব্যবসায়ী বাবা প্রায়শই আক্ষেপ করতেন, আমার ছেলেটার ব্যবসায় মতিগতি নেই! তার শুধু ফুটবল আর ফিজিক্স! সেই প্রকাশদাই কিনা হঠাৎ একদিন বাবাকে গিয়ে বলল, আমি মুরগির ফার্ম খুলব! ছেলের ওপর জিনে ভর করেছে ভেবে প্রকাশদার বাবা ছুটলেন ওঝার কাছে। কিন্তু আমরা তো জানতাম, প্রকাশদার মাথা খেয়েছিল তরুণ মজুমদারের ‘ভালবাসা ভালবাসা’ সিনেমাটা। মুরগির ফার্মের মালিক তাপস পাল ডিম সাপ্লাইয়ের সুযোগে মেয়েদের হস্টেলে ঢুকে দেবশ্রীকে বাগিয়ে নিয়েছিলেন! ব্যবসা করলে প্রেম ফ্রি!
এর অনেকদিন বাদে আমি চলে এলাম পশ্চিমে, একদা বাঙালি যেমন যেত হাওয়া বদলের জন্য, মধুপুরের বদলে মার্কিন দেশে। আর এসেই মালুম পেলাম যে, হাওয়া এমন বদলেছে যে, পালটে গেছে প্রেমের পদবী, রোমান্সের রকম, রোমান্টিকতার রং! এক প্রবাসী বাঙালির মার্কিনজাত যুবতীকন্যাকে শুধিয়েছিলাম, কী রে, প্রেমট্রেম কচ্ছিস? জবাবে মেয়েটি বলেছিল, ইউ মিন ডেটিং? অ্যাজ ইউ গাইজ সে ‘প্রেম করা’! ইটস এ কাইন্ড অফ ডিল!
এতদ্বারা ‘আমেরিকান’ আমি প্রকাশদার সেই ‘ট্রেড সিক্রেট’-টা বুঝতে পেরেছিলাম, ডিল করলে ডেটিং ফাউ! আমাদের সময় অবশ্য প্রেমের ইংরেজি ছিল ‘লাভ’, যাতে লাভ লোকসানের ব্যবসা ছিল না। তখন তারিখের ইংরেজি ছিল ‘ডেট’! ১৮৯৯ সালে ‘ফেবলস ইন স্ল্যাং’ নামে একটা আজগুবি বইয়ে ‘ডেট ইক্যুয়াল টু প্রেম’ ফর্মুলাটা ছকলেন শিকাগোর সাংবাদিক জর্জ এড। তাঁর যুক্তি, তারিখ ব্যাপারটা তো কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্টের সঙ্গেই জড়িত। তাহলে ছেলেমেয়েরা যখন প্রেম ‘হলেও হতে পারে’ এমন কারও সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, সেটাও ডেটিং। ‘লাভ’ একটা ফিলিং, আর ‘ডেটিং’ হল তার অ্যাকশন।
১৯৫৭ সালে এই প্রেমপুজোয় ঢাকের বাদ্যি বাজালেন মার্কিন ব্যবসায়ী জর্জ ক্রেন। ‘দি সায়েন্টিফিক ম্যারেজ ফাউন্ডেশন’ নাম দিয়ে তিনি বৈদ্যুতিন ঘটকালির কারবার খুলে বসলেন। ওই শুরু হল ‘ইন্ডোর’ স্বয়ংবর সভা। ‘ডেটা’ দিলেই হাতের মুঠোয় ডেটিং। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গাত্রবর্ণ, মাসমায়না, সম্পত্তি, ঠিকুজি, এমনকি ধর্ম ‘শেয়ার’ করলেই একদম দুয়ারে বিয়ে! বিয়ে থা’র কথা শুধোলেই এলিজিবল ব্যাচেলরদের উত্তর, আই অ্যাম ইন দি মার্কেট। কাজেই ওই শেয়ার বাজারে লঞ্চ করল একাধিক ডেটিং সাইট। তার লেজ ধরে চলে এল কিছু ‘এস্টিমেশন’ ওয়েবসাইট, যেখানে একবারটি ঢুকলে ডেটিং সাইটে পাওয়া পাত্রপাত্রীর মধ্যে কাকে বাছলে হবে রাজযোটক, সেটাও বাতলে দেবে তারা! মণিকাঞ্চন যোগ ঘটবে অতিসহজে, মহাসত্বরে ‘ডেট’র হোম ডেলিভারি!
দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী দীর্ঘ বরষ মাস অপেক্ষার দিন শেষ। পাঠ্যবইয়ের পাতার ভাঁজে লুকিয়ে রঙিন খামে যত্নে লেখা চিঠি দিতে হবে না আর। প্রেম এখন ‘হ্যান্ডি’, ‘ইউজার ফ্রেন্ডলি’। সেদিন ওই মেয়েটা আমাকে বলেছিল, নো ডেটিং ইয়েট। টু মাচ ওয়ার্ক অ্যান্ড ট্রাবল! ট্রাবল! যন্ত্রণা! ‘সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়’। প্রেম ভালোবাসা আর কত ‘শর্টকাট’ হবে? এবার যন্ত্রডিলাররা ভার্চুয়াল ডেটিংয়ের জন্য বাড়িতে রোবট পাঠিয়ে দেবেন। সেজন্য রোবটিক্সে ইনভেস্ট করছেন তাঁরা। এতকিছুর পরও ওই মেয়েটা আমাকে বলেছিল, ডেটিং করলেই রিলেশনে একটা পজেসিভনেস চলে আসে। নো প্রাইভেসি। আমাদের সময় এই পজেসিভনেসের বাংলা ছিল ‘আকুতি’। আর ‘নো প্রাইভেসি’র ভাষান্তর ছিল বন্ধুত্ব, সম্পর্ক। পোস্টমডার্ন পশ্চিম অবশ্য মনে করে, কাউকে ‘আই লাভ ইউ’ বলা মানে ‘বদার’ করা! ডেটিংটা বরং ‘এআই’র হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
সেই কাজটাই এখন করছেন রোবটিক্সের লোকরা। রোবটবিজ্ঞানের জনক জোসেফ এঙ্গেলবার্গার ‘ইকনমিক অ্যান্ড সোশিওলজিক্যাল ইমপ্যাক্ট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট’ প্রবন্ধে লিখেছেন, আমরা যে ‘সাইকোরোবট’-এর কথা ভাবছি, সেটাই ভাবীকালের ডেটিং ইন্ডাস্ট্রিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। একটাই চ্যালেঞ্জ, আমরা রোবটের কমপ্লেক্সনটা কী হবে, বুঝতে পারছি না। কিন্তু জোসেফ সাহেব, রোবটের বর্ণবিচার করতে গিয়ে প্রেমের রামধনুর সাতটি রংই ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে যে! বরং প্রেমে স্পষ্টতর হচ্ছে শুধু দুটি দুষ্টু রং, ভালোবাসার নয়, শরীরের। সাদা আর কালো। সুদীর্ঘ মার্কিনবাসে সাদাকালোর প্রেম বা বিয়ে আমার চোখেই পড়েইনি প্রায়। আর শুধু ‘রেস’র রং নয়, ডেটিং বা ওয়েডিংয়ে রিলিজিয়নের দুটো ‘কাটাদাগ’-ও আছে। কোরান বাইবেল-কেও মিলতে দেখিনি তেমন! এই সব ধর্মবর্ণ ঝাড়াইবাছাই করেই খাপে খাপ ‘ডেট’ ডেলিভারি করে ‘আলাদিনের ওয়েবসাইট’!
প্রেমের সময় বাঁচল। ভালোবাসার হ্যাপা কমল। কিন্তু প্রেম ভালোবাসায় মানুষের এমন আলস্য আর অবসাদ দেখা দিল কীভাবে? ‘দ্য সাইকোলজি অফ মডার্ন ডেটিং’ গ্রন্থে শন ব্লু’র ব্যাখ্যা, হাইস্কুলেই গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলে অনেকে। অপরিণত মনের সেইসব ভুলভ্রান্তির ভালোবাসা খুব একটা টেকে না। কলেজে উঠলেই সবাই বাড়ির বাইরে। একখান প্রেমিক বা প্রেমিকা জুটলেই ‘লিভ টুগেদার’, স্বামী-স্ত্রীর মতোই থাকা। এই খুল্লামখুল্লা জীবন গোগ্রাসে গিলতে গিয়ে হারিয়ে যায় সেই ভীরু ভীরু চোখ, দুরুদুরু বুক, প্রেমের পূর্বরাগ! খুব দ্রুত ভালোবাসা একঘেয়ে হয়ে যায়। ক্লান্তি জাগে প্রেমে। এরপর চাকরিবাকরি পেলে যে মেলামেশাটা শুরু হয়, সেটা ‘ডেটিং ডিল’! লাগলে তুক, না লাগলে তাক। প্রেম আসলে একটা ‘মাল্টিপল চয়েস কোয়েসচন’!
ভালোবাসা কি সত্যিই এমন ‘শেষের কবিতা’? তবে কেন সেদিন সকালে লাবণ্যকে অমিত পড়ে শুনিয়েছিল জন ডনের কবিতার বইয়ের সেই পদ্যাংশ! লাবণ্যের শরীরটা কেঁপে উঠেছিল তখন। তার চন্দ্রহারে কাজলধোয়া জল হয়ে ঝরে পড়েছিল রবি ঠাকুরের সেই অমর তর্জমা! ‘দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর / ভালবাসিবারে দে আমারে অবসর’!