সৃষ্টি মনে ধরলে তবেই আমরা অমর

সৃষ্টি মনে ধরলে তবেই আমরা অমর

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


  • মাল‍্যবান মিত্র

অমরত্বের প্রত্যাশা এখন শুধুই বিজ্ঞানের কল্পনা নয়, শিল্পের, কবিতার, সংগীতেরও এক অলৌকিক আকাঙ্ক্ষা। এ যেন জাতিস্মরের সেই আত্মার দীর্ঘশ্বাস, যে পূর্বজন্মের রাগ ভাসিয়ে দেয় বর্তমানের গলায়। মানুষ জানে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তবুও সে চিরজীবনের খোঁজে একটানা ছুটে চলে-না কেবল রক্ত-মাংসের অস্তিত্ব নিয়ে নয় বরং তার চিন্তা, অনুভব ও সৃষ্টিকে ধরে রাখার লালসায়। এই অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা কখনও মিথের আকাশে, কখনও বিজ্ঞানের গবেষণাগারে আবার কখনও কবিতার ছায়ায় নিজের ছাপ রেখে গেছে।

গিলগামেশ মহাকাব্যের নায়ক যেমন মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে সমুদ্র পাড়ি দেন, আজকের মানুষ তেমনি মস্তিষ্ককে ক্লাউডে আপলোড করে একপ্রকার ‘ডিজিটাল অমরত্ব’ খুঁজছে। বিখ্যাত লেখক তথা দার্শনিক ও সমালোচক রে কার্জওয়েইল তাদের জন‍্য আশাবাদী। তাঁর লেখনীতে, ‘২০৪৫ সাল নাগাদ আমরা হয়তো ডিজিটাল অমরত্ব খুঁজে পাবে।’  তবু প্রশ্ন রয়েই যায়-এ কি সত্যিকারের অমরতা, নাকি শুধুই অস্তিত্বের প্রতিলিপি?

যখন আমরা একটি কবিতা লিখি, একটি গল্প বলি বা একটি নাটকে নিজেকে মেলে ধরি-তখনই কি আমরা অমর হই না? ইলিয়াড ও হ্যামলেট আজও জীবন্ত। হ্যারল্ড ব্লুম বলেছিলেন, ‘অনন্য সাহিত্যের মৃত্যু হয় না। তার পুনর্জন্ম হতে থাকে।’ শব্দই সময়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুনীল, শক্তি-তাঁরা সবাই ভাষার মধ্যে দিয়ে নিজেদের মৃত্যুকে অতিক্রম করেছেন। অন্যদিকে,  অজন্তার গুহাচিত্র, দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা, বা পিকাসোর বিভ্রান্ত রেখায় আমরা দেখতে পাই-মৃত্যুর পেরিয়ে যাওয়ার ব্যাকুলতা। শিল্পীর রঙের টানে, সুরের ফোঁটায়, নিজের মৃত্যুকে অতিক্রম করে সে পৌঁছে যায় ভবিষ্যতের দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে।

রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘মৃত্যু আমারে করে যে স্তব, অমৃত সেই স্তবগান।’ অন‍্যদিকে জীবনানন্দের কথায়, ‘আমি জানি এই জীবনের কোনও মানে নাই / তবুও আমি মরিতে চাই না।’ তেমনই বুদ্ধদেব বসু লিখছেন,  ‘মৃত্যুর পরে শোক নয়, আলো।’ এইসব কণ্ঠ একসঙ্গে এক আত্মিক অভিজ্ঞান তৈরি করে-যেখানে মৃত্যু একমাত্র পরিণতি নয়, বরং সৃষ্টি হয়ে ওঠে তার উত্তর।

তবে সিনেমার কথা আলাদা। সিনেমা হল মুহূর্তকে চিরস্থায়ী করে রাখার মাধ্যম। আর তাই শার্লক হোমস–এর ধোঁয়ায় ঢাকা চেহারা, উত্তম-সুচিত্রার চোখের ভাষা, সৌমিত্রর স্তব্ধতা—-সবই ফ্রেমবন্দি হয়ে আমাদের স্মৃতিতে থেকে গিয়েছে অমরত্বের বাজারজাত স্বপ্ন হিসাবে,  হলিউড থেকে টলিউড-‘স্টার সিস্টেম’ গড়ে তোলে এক কৃত্রিম চিরন্তনতা। উত্তমকুমার আজও ‘মহানায়ক’, দেব আনন্দ চিরতরুণ এবং মেরিলিন মনরো যৌবনের প্রতীক। ভারতে তৈরি কৃশ-থ্রি চলচ্চিত্রে হৃত্বিক রোশনের দ্বৈত চরিত্র-বাবা ও পুত্র কেবল বংশগতির নয়, বরং আত্মপরিচয়ের এক অবিনশ্বর ধারাবাহিকতা। এই সিনেমা সুপারহিরোর মাধ্যমে দেখায়, কীভাবে মৃত্যু বা দুর্বলতাকে অতিক্রম করে এক অমর সত্তা হয়ে ওঠা যায়। সিজিআই, ভিএফএক্স এবং পোস্ট-প্রোডাকশন প্রযুক্তি এমন একটি দেহ নির্মাণ করে, যা মৃত্যুরও ঊর্ধ্বে। আবার ক্যারি ফিশার বা শ্রীদেবীর মতো অভিনেত্রীদের ডিজিটাল অবতার তৈরির উদ্যোগ ‘পশ্চুমান ইমেজ’ ধারণাটিকে সামনে আনে-যেখানে শরীর মরে যায়, কিন্তু ইমেজ বেঁচে থাকে।

ভানু বন্দ্যোপাধ‍্যায় ও রুমা গুহঠাকুরতা অভিনীত ‘আশিতে আসিও না’ -এই বাংলা ছবিটি প্রবীণ বয়সের ভয়াবহ একাকিত্ব ও মরতে বসা স্মৃতির ভেতর দিয়ে মৃত্যুর ধারণাকে অস্বীকার করে। প্রাচীন যযাতির উপাখ‍্যানের রিমেক হয় ছবির প্রবীণ নায়ক একজীবনের স্মৃতি-আক্রান্ত পথ দিয়ে হাঁটেন সেখানে বারবার মনে পড়ে পুরোনো বন্ধু, প্রেম, সিনেমা হল, রেডিও। এ যেন মৃত্যুর ভেতর দিয়েই বেঁচে থাকার এক সংগ্রাম-চোখে জল আসে, অথচ সে জল সিনেমার আলোয় ঝলমল করে ওঠে। চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক হেনরি বার্গসনের কথায়, ‘বর্তমান প্রতিটি মুহূর্তই অতীতের মৃত সময়কে বহন করে।’ কিন্তু সে কি অমর করে তোলে? নাকি শুধু মৃত্যুর এক সুন্দর সংরক্ষণ? আমরা সিনেমায় যে মুহূর্ত দেখি তা একদিন বাস্তব ছিল, তারপর ক্যামেরায় ধরা পড়ল, আজ তা স্মৃতিতে পরিণত। সিনেমা চায় অমর হতে, কিন্তু সে আসলে এক স্মৃতিমেদুর শোকগাথা যেখানে আমরা আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনকে চিরন্তনের ছায়ায় রাখি।

তাহলে অমরত্বের আসল বসবাস কোথায়? সাহিত্য, শিল্প ও সিনেমা- তিনটি ক্ষেত্রেই অমরত্বের সন্ধান এক অভিন্ন অনুভূতি। আমরা জানি, শরীর ক্ষণস্থায়ী।

তবু যখন কেউ একটি কবিতা লেখেন, একটি ছবি আঁকেন, বা ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে একটি সংলাপ বলেন তখনই তিনি অমর হয়ে ওঠেন অন্যের স্মৃতিতে।

অমরত্ব কোনও ‘শারীরিক অবস্থা’ নয়- এটি এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিফলন। যদি কেউ আমাদের সৃষ্টি মনে রাখে তবেই আমরা অমর হতে পারি।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *