- সুদীপ চৌধুরী
ফোনটা পেয়ে মজুমদারবাবু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। কম তো দেখতে এল না। আসে, বসে, দেখে, প্লেট ভরে মিষ্টি খায়। যাওয়ার সময় মজুমদারবাবু সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসেন। হাতজোড় করে বলেন- একটু দেখবেন দাদা। তারপর শুধু অপেক্ষা। ফোন করলে নানা অজুহাত- হাইট শর্ট, আমরা একটু ফর্সা চাইছিলাম, চাকরিটা পার্মানেন্ট হবে কিনা তার তো কোনও সিওরিটি নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। যাক, এবার তাহলে অনেকটা এগিয়েছে। মজুমদার গিন্নি ঠাকুরের কাছে মানত করেছে ব্যাপারটা ম্যাচিওর হলে একটা বড় করে বিপত্তারিণী মায়ের পুজো দেবেন।
আজ ওরা দেখতে আসবে। এর আগে গত রোববার ওদের পক্ষ থেকে দুই অভিভাবক ও দুই আত্মীয় দেখতে এসেছিল। ওদের পছন্দ হয়েছে। তাই কাল ফোন করে জানিয়েছে আজ পাত্রী ও তার দুই বন্ধু পাত্র দেখতে আসবে। মজুমদারবাবু তাঁর গিন্নি ও ছেলে সুমনকে ডেকে সে কথা জানিয়ে দিলেন। পাশের ঘর থেকে সুমনের ভাই টুপাই আনন্দে আত্মহারা- দাদা, আমি কিন্তু আমার তিনজন বেস্ট ফ্রেন্ডকে ইনভাইট করব। আর বিরিয়ানি করতেই হবে। মজুমদার গিন্নি রেগে গিয়ে বললেন- এই জন্যই তো শুভ কাজটা হয় না। আগে সব ফাইনাল হোক, তার আগেই কাকে নেমন্তন্ন করবে, কী মেনু হবে তার হিসেব কষা শুরু করেছিস! ঠাকুর ঠাকুর!!
সুমন আজ সকাল সকাল ফেসিয়াল করিয়েছে। চুলে শ্যাম্পু দিয়েছে। দুইবারের জায়গায় চারবার দাড়ি সেভ করেছে। আয়নার সামনে গালের বাঁদিক ডানদিক গলার উপর থুতনির নীচে সব জায়গায় ভালো করে চেক করে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে যে কোথাও একটাও দাড়ি লেগে নেই। এক্কেবারে সাফা। নাসিকা ছিদ্র দুটি যথাসম্ভব বড় করে ঝাড়ুর শোলার মতো খাড়া খাড়া নাকের লোম একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলেছে। গোঁফটাও দারুণ করে ছেঁটেছে। একটা লাল হয়ে যাওয়া লোম চন্দন ঠাকুরের চোখে পড়েনি। পরে সুমনের চোখে সেটা পড়াতে সুমন চন্দন ঠাকুরকে ধমক দিয়ে বলেছে- চোখের মাথা খেয়েছো নাকি? কাট এটাকে!
আসলে সুমন এবারে কোনও রিস্ক নিতে চায় না। এর আগে এক পাত্রীপক্ষ দেখতে এসে সুমনের লালচে ডায় করা চুল আর লাল হয়ে যাওয়া মোচ দেখে রিজেক্ট করে দিয়েছিল। তাই এবার সুমন বিশেষভাবে সতর্ক। এর আগে প্রতিবার সুমন জিনসের প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে কলার উঁচু করে গলার বাঘ মার্কা শিকলের মতো চেনটা কিছুটা দৃশ্যগোচর করে ইন্টারভিউতে বসেছিল। পরে জানতে পেরেছিল তার এই আধুনিক মার্কা লুক নাকি কোনও পাত্রীর পছন্দ হয়নি। সুমন অবাক হয়ে ভেবেছিল মেয়েদের মন বোঝা বড় কঠিন। কলেজ লাইফে তো ও রিতা, মৌরসী, কাবেরী, টুম্পাদের সঙ্গে মিশে এরকমটাই বুঝেছিল যে মেয়েরা এরকম স্মার্ট ছেলেই পছন্দ করে। আর বিয়ের বাজারে শালা উলটো! মাইরি! যাইহোক, এসব নিয়ে তো আর তর্ক বাড়ানো যাবে না। বয়সটা তো আর বসে নেই। এটা ফসকালে আবার অপেক্ষা আর অপেক্ষা। শেষে দেখা যাবে আর হলই না। সুমন তাই আজ খুব সুন্দর একটা সাদার উপর মেরুন কাজ করা সিল্কের পাঞ্জাবি পরেছে। তার সঙ্গে দুধসাদা চুড়িদার পাজামা। দুই হাতের আঙুলে পাথরের আংটি। কোন এক অ্যাস্ট্রোলজারকে দেখিয়ে নিজের ট্যাঁকের মোটা অর্থ গচ্ছা দিয়ে একটা গোমেদ ও একটা চুনির আংটি গড়িয়ে দিয়েছিল যাতে সুমনের রাহুর দোষ কাটে, আর বিয়েটাও তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। পুত্র দায়গ্রস্ত থেকে যাতে মজুমদার কর্তা-গিন্নি রেহাই পায়।
সুমনের আজকে কেমন নার্ভাস লাগছে। টেনশনও হচ্ছে। সুমন ওর মাকে বলল- মা, আজকে বিকেলে সুশান্তকে বলি আমার সঙ্গে থাকতে? মজুমদার গিন্নি আবার চটে গিয়ে বললেন- কেন, পাত্রী তোকে দেখতে আসবে নাকি সুশান্তকে শুনি? যত্তসব! কোনও শুভকাজে এখনই বাইরের কাউকে বলার কী আছে শুনি? আজকাল মানুষের মন বা নজর একটাও ভালো না। তার মধ্যে সুশান্তর এখনও বিয়ে হয়নি। বয়সে তো তোর চাইতে অনেকটাই বড়। ওর একটা চাপা কষ্ট থাকতেই পারে। আর…। মজুমদারবাবু সুর মিলিয়ে বললেন- তোর এজন্যই তো কোনও গতি হয় না। এ বিষয়ে একটা কথাও কাউকে জানাবি না। আগের থেকেই ঢাকঢোল পেটানো। আশ্চর্য! আগে সব হোক তারপর! সুমন ধমক খেয়ে একেবারে চুপসে গেল।
(২)
বিকেলে পাত্রী ও তার দুই বান্ধবী মজুমদারবাবুর বাড়িতে এল। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে সুমন ঐন্দ্রিলাকে দেখছিল। দারুণ দেখাচ্ছিল। একটা হলুদ টি-শার্ট আর নেভি ব্লু জিনস-এর বডি ফিটিংস প্যান্ট। ওর অন্য দুই বন্ধুকেও প্যান্ট-শার্টে খুব স্মার্ট লাগছে। তিনজনকে দেখে সুমনের মনটা হঠাৎ কেমন আঁতকে উঠল। হায় ভগবান! শুভকাজে তিনজন মানে বেজোড়! মনে মনে বলল- ভগবান! আমার মুখের দিকে তাকিও। এটা যেন ফসকে না যায়।
ঐন্দ্রিলা সানগ্লাসটা টি-শার্টে ঝুলিয়ে স্কুটিটা স্ট্যান্ড করে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কী দেখে আবার পকেটে রেখে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। একঝলক দেখাতেই মনে মনে সুমন ঐন্দ্রিলার প্রেমে পড়ে গেল। বজরঙ্গবলীর কাছে মানত করে বলল- বাবা, তোমার ভক্তের যেন এবার গতি হয়। আমি যেন আমার জীবনে পত্নীদেবী হিসেবে ঐন্দ্রিলাকে পাই। আমি তোমাকে এক কাঁদি কলা দিয়ে পুজো দেব মালবাজারে তোমার জাগ্রত মন্দিরে গিয়ে।
প্রাথমিক পর্বে চা মিষ্টি খাওয়া-দাওয়ার পর ঐন্দ্রিলার বন্ধু সাগরিকা বলল- দাদা, আমাদের উঠতে হবে। হাতে বেশি সময় নেই। নিয়ে আসুন আপনাদের ছেলেকে। কী বলিস ঐন্দ্রিলা? আত্মীয়টা পাকা হলে তখন তো অনেক গল্প করা যাবে। ঐন্দ্রিলার অপর বন্ধু মৌরী মজা করে বলল- আর বলিস না সাগরিকা, বিয়ের পর তো দেখা যায় বেশির ভাগ ছেলে এমন বৌ-চাটা হয় যে মা-বাবা ভাই-বোন বন্ধুবান্ধব সকলকে ভুলে গিয়ে বৌয়ের পিছনে সেঁটে থাকে। কথাটা কানে যেতে সুমন মনে মনে বলল- এটা তো সনাতন ধর্ম হয়ে আসছে যে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িই ছেলেদের সব। আমাকেও সেটাই মেনে চলতে হবে। ঐন্দ্রিলা গো! আমি নিশ্চয়ই তোমার বাড়ির সকলকে মানিয়ে নিয়ে চলব। দেখ, তোমাকে কথা দিলাম। শুধু একবার সে সুযোগটা দাও লক্ষ্মী। পাশে দাঁড়িয়েছিল টুপাই। সুমনকে চিমটি কেটে বলল – কী বিড়বিড় করছিস রে দাদাভাই? টেনশন হচ্ছে নাকি? সুমন লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে বলল- কই, কিছু না তো!
ইতিমধ্যে মজুমদার গিন্নি ঘরে ঢুকে বললেন- কী রে সুমন, রেডি? চল বাবা, ওদের আবার তাড়া আছে। সুমন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নিজের মুখটা ভালো করে দেখে নিল। সব ঠিকঠাক আছে। ঠোঁটে খুব হালকা করে লিপস্টিক মেখে ছিল। আলতো করে আর একবার প্রলেপ দিয়ে উপরের ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁটটাকে চেপে নিয়ে ফিনিশিং টাচ দিয়ে নিল।
পর্দা সরিয়ে সুমন ওর মা’র পিছন পিছন লক্ষ্মী ছেলের মতো ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল।
ঐন্দ্রিলাদের সামনে রাখা একটি চেয়ারে এসে বসল সুমন। নমস্কার-প্রতিনমস্কারের পালা শেষ হলে মজুমদারবাবু ঐন্দ্রিলাদের উদ্দেশ্যে বললেন- আমরা উঠি। তোমাদের মধ্যে কথাবার্তা থাকলে কিছু জিজ্ঞাসা থাকলে তা খোলাখুলি সেরে নেওয়া ভালো। চলো, আমরা উঠি। এই বলে মজুমদারবাবু ও গিন্নি ভিতর ঘরে চলে এলেন।
এবার ঐন্দ্রিলা প্রথমে জিজ্ঞাসা করল- দেখুন আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন আমি একটা কোম্পানির এগজিকিউটিভ পোস্টে সার্ভিস করছি। আমাকে তো অফিশিয়াল ট্যুরে মাঝে মাঝেই বাইরে যেতে হয়। ইনফ্যাক্ট মাসের বেশিরভাগ দিন আউট অফ স্টেশন। তা আপনি সেটা মানিয়ে নিতে পারবেন তো? আপনার মায়ের কাছে শুনলাম আপনি রান্নাবান্না ভালোই করতে পারেন। প্রয়োজনে দু’চারদিন চালিয়ে নিতে পারবেন তো? না, মানে আমাদের রান্নার মাসি আছে, কিন্তু কোনও কারণে দু’চারদিন না আসতে পারলে সেই সময়টা আর কী। মার বয়স হয়েছে তো, তাঁর দ্বারা সম্ভব নয়। সেজন্য বললাম। সুমন লাজুক নয়নে মাথা নেড়ে বলল- অসুবিধে হবে না। মা তো প্রায় অসুস্থ থাকেন, তখন তো আমাকেই করতে হয়। আমাদের তো আর রান্নার লোক নেই। ঐন্দ্রিলা বলল- বেশ, ভালো। আর ওই যে বলছিলাম বাইরে ট্যুরে যাওয়ার ব্যাপারটা। সুমন হালকা হেসে বলল- প্রয়োজনে মানুষকে সব মানিয়ে নিতে হয়। সাগরিকা মুচকি হেসে বলল- তাহলে তো ঐন্দ্রিলা তোর একটা সমস্যার সমাধান হল। আর যেন কী তোর কয়্যারি আছে? ঐন্দ্রিলা বলল- না, আর তেমন কিছু নেই বলার। তবে দেখুন, আমার মা-বাবার বয়স হয়েছে। তাদের যাতে যত্নআত্তির কমতি না হয় সেটা তো আমাদের দেখার ব্যাপার। যেমন আপনার মা-বাবাকেও আমাদেরই দেখতে হবে, তাই না? সুমন মাথা নীচু করে উত্তর দিল- দেখুন, এটা তো আমাদের কর্তব্য। একদিন তো আমরাও বার্ধক্যে পৌঁছাব, তখন তো আমরাও এতটুকু আমাদের সন্তানসন্ততির কাছ থেকে আশা করবই। মৌরি মুচকি হেসে বলল- আপনি দশে দশ পেয়ে গেলেন। খুব ভালো লাগল। আচ্ছা, আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?
ঐন্দ্রিলা হেসে বলল- নিশ্চয়ই, আমরা তো খোলাখুলি আলোচনা করছি। বন্ধুর মতো। সুমন বিনয়ের সঙ্গে বলল- অবশ্যই, বলুন না। সুমন কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে বলে ফেলল- দাম্পত্যজীবনের সবচাইতে বড় সম্পর্ক হল এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বলুন আপনি। সুমনের এই দার্শনিক মার্কা কথা শুনে মৌরি আর হাসি চাপতে পারল না। বলল- পাত্রীটা কিন্তু আমি নই। পাত্রী হল আমার বান্ধবী ওই ঐন্দ্রিলা। সবাই হেসে উঠল। তারপর বলল- আপনার প্রিয় শখ? আমার বন্ধুটির কিন্তু প্রিয় শখ ভ্রমণ। সুমন বলল- আমারও সেই শখ আছে। কিন্তু দেখুন আমি একটা প্রাইভেট সার্ভিস করি। ঘোরার জন্য অর্থের দরকার, তাই না? তবে আমার আর একটা বড্ড শখ হল ঘর গোছানো। সাগরিকা বলল- তা আমরা মেসোমশাইয়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছি। এত সুন্দর করে ঘরটা তো আপনি গুছিয়েছেন, তাই না? এই ফেব্রিকের বেড কভারটাও তো আপনার করা শুনলাম। সুমন সলজ্জে বলল- ওই একটু- আধটু করি আরকি সময় পেলে। ঐন্দ্রিলা বলল- আমারও ঘর গোছানোর খুব শখ। টিভি সিরিয়ালগুলোতে দেখা যায় কী সুন্দর ঘরগুলো গোছানো। আমার খুব ইচ্ছে করে ওরকম করে ঘর গোছাবো। আসলে সময় পাই না তো। মৌরি বলল- তোর আর চিন্তা কী, সুমনবাবু তো আছেন। সবাই হেসে উঠল।
ঐন্দ্রিলা জিজ্ঞাসা করল- আপনার যদি কিছু জানার থাকে তো আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন। সুমন মাথা নেড়ে বলল- না, আমার তেমন কিছু জিজ্ঞাসা নেই। মৌরি ফোড়ং কেটে বলল- ‘তেমন কিছু নেই’ মানে কিছু তো আছে, বলুন না। ঐন্দ্রিলা বলল- এগজ্যাক্টলি দ্যাট। বলুন বলুন। সুমন এবার মাথা উঁচু করে সলজ্জে বলল- আসলে আমার ভাইটার লেখাপড়ার দায়িত্ব তো আমার উপরে, বাবার যা পেনশন তা দিয়ে সবটা হয় না।
ঐন্দ্রিলা বলল- তাই কী বলুন না।
–না, মানে বলছিলাম কি আফটার ম্যারেজ আমি ভাইয়ের পড়ার খরচটা চালাতে চাই। ঐন্দ্রিলা বলল- সো গুড এন্ আইডিয়া! আমিও তো আছি শুধু আপনি কেন? দেখুন, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে কার কোথায় কখন লেখা আছে সে তো কেউ বলতে পারে না। তবে আমি তো স্পষ্ট কথা বলতে ভালোবাসি। যদি ধরুন আমাদের এই রিলেশনটা ম্যাচিওর করে তবে সে বিষয়ে আমার তরফ থেকে কোনও অসুবিধে থাকবে না। এ কথাটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আর আপনি সার্ভিসটাও চালিয়ে যেতে পারবেন সে তো আমি সম্বন্ধটা আসার সময় বলে দিয়েছি। একটা বোরোলিন বা একটা শখ-আহ্লাদের জিনিস বা কোনও কিছু কেনার জন্য স্ত্রীর কাছে সবসময় হাত পাততে হবে এটা খুব বিশ্রী ব্যাপার, কারণ আমি মনে করি আজকাল ছেলেদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো খুব দরকার। ছেলেদের রাঁধার পর খাওয়া আর খাওয়ার পর রাঁধা আমার মোটেই পছন্দ নয়। বিয়ের পর একটা ছেলে শ্বশুরবাড়িতে এসে শ্বশুরবাড়ির জন্য নিজেকে সঁপে দিয়ে নিজের আইডেন্টিটিটা হারাবে এটা আমি বিশ্বাস করি না। হাউইভার, এবার আপনার যদি আর কোনও প্রশ্ন থাকে তো আপনি অনায়াসে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। নো প্রবলেম, নো হেজিটেশন প্লিজ।
সুমনের বুকটা ধড়াস করে উঠল। তাই তো জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে কার কপালে কী লেখা আছে সত্যিই তো জানা নেই। আমার এখানে বিয়েটা তো নাও হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে সুমন উচ্চারণ করল- ঠাকুর! ঠাকুর! সুমন একটু চুপ করে থেকে বলল- না, আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই। সাগরিকা বলল- বেশ ভালো লাগল আপনার সঙ্গে কথা বলতে। মৌরি বলল- ঐন্দ্রিলা আমাদের তো এবার উঠতে হয়। ঐন্দ্রিলা বলল- হ্যাঁ, আমাকে আবার একবার অফিসে ঢু দিয়ে যেতে হবে। ঠিক আছে। এবার আপনি উঠতে পারেন।
সুমন নমস্কার জানিয়ে উঠে গেল। মজুমদারবাবু ও তার গিন্নি প্রবেশ করলে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানিয়ে ঘরের বাইরে পা রাখল। ঐন্দ্রিলা বলল-আপনারা ভালো থাকবেন। সুমন জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখছিল ঐন্দ্রিলাকে আর বজরঙ্গবলীকে ডাকছিল।
(৩)
ঐন্দ্রিলার সব বন্ধুদের বেশ পছন্দ হয়েছে সুমনকে। ছেলেকে ঐন্দ্রিলার পছন্দ হয়েছে। শিক্ষিত গৃহকর্মে নিপুণ, দায়িত্বপূর্ণ, দেখতে শুনতেও খারাপ না। তার মধ্যে তুলা রাশি। ছেলের বাড়িতে মেয়ের বাবা ফোন করে আজ সব জানিয়ে দিলেন তাঁরা এখানেই জাজ করবেন এবং প্রাথমিক সব কথাবার্তা সেরে নিলেন। শুভস্য শীঘ্রম। আগামী ২৪শে শ্রাবণ শুভ দিন।
বাসবোঝাই কন্যাযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে এসেছে ঐন্দ্রিলা। আগুনকে সাক্ষী রেখে সুমনের হাতে হাত রেখে ঐন্দ্রিলা শপথ নিল- আজ হতে আমি তোমার ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব… ইত্যাদি ইত্যাদি। সুমন খুব কষ্টে চোখের জল ধরে রেখেছে। কাল থেকেই তাকে বাড়ি ছেড়ে এক নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকতে হবে। শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জুগিয়ে চলতে হবে। হাজার কষ্ট বুকে চেপে সংসার করতে হবে। পাঁচালীতে লেখা আছে সংসার সুখের হয় পুরুষের গুণে। সুমনের মা পইপই করে সব শিখিয়ে দিয়েছে। ঘুমের থেকে উঠে বাসি কাপড় ছাড়তে হবে, ঐন্দ্রিলার অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকলে চা-ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিতে হবে ইত্যাদি। সুমন মার কাছ থেকে সংসারের এইসব সাতকাহন সব শুনেছে এবং যথাসম্ভব তা পালন করবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ওর কাছে দাম্পত্যজীবন ও সংসার একটা চ্যালেঞ্জ। আর ছেলেদের এই এক জ্বালা- এই সমাজে যত দোষ নন্দা ঘোষের হয় না, হয় নন্দ ঘোষের।
সন্ধে হয়েছে। এবার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পালা। সুমনের বন্ধুবান্ধবরা সব জড়ো হয়েছে সুমনকে শুভ বিদায় জানাতে। সুমনের মা-বাবা-ভাই কান্নাকাটি শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। ঐন্দ্রিলা হাত ধরে বলেছে মা-বাবা আপনাদের ছেলে ভালোভাবেই থাকবে, কোনও কষ্ট হবে না। তাছাড়া আমি তো বলেছি মন খারাপ লাগলে আমি তোমাকে তোমার বাপের বাড়ি দিয়ে যাব, দু’দিন কাটিয়ে আমাকে ফোন করবে। আমি আবার অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় নিয়ে যাব।
মজুমদার দম্পতি মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন। ছেলেটার বিয়ে হয় না হয় না শেষে ঈশ্বর বাড়ির সামনেই এত ভালো একটি পাত্রী জুটিয়ে দিল। পাড়ার সবাই বলল- না, মানতে হবে। মজুমদার গিন্নির ছেলের সত্যিই খুব ভালো বিয়ে হয়েছে।
গাড়ি ছাড়বে। উলু, শঙ্খধ্বনি শুরু হয়ে গেছে। সুমন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। প্রথমে চেপে চেপে তারপর উচ্চস্বরে কান্না শুরু করে দিল। ঐন্দ্রিলা যত বোঝায়, ততই ওর কান্নার ডেসিবেল বাড়তে থাকে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মা-বাবা ও একমাত্র ভাইকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে সেই কান্না জুড়ে দিয়েছে সুমন। শেষে ঐন্দ্রিলা মৌরিকে বলল- তুই গাড়ি স্টার্ট দে মৌরি। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ামাত্র সুমনের কান্না শতগুণ বেড়ে গেল।
সত্যি আমারও চোখে জল চলে এসেছিল, কারণ এমন দিন তো প্রত্যেক ছেলের জীবনে আজ না হোক কাল তো আসবেই…।