- মানসী কবিরাজ
অ্যালবামের পাতা ওলটালেই দেখা যাবে আমাদের প্রায় সবারই ঝোলাতে স্কুলের বাংলা পরীক্ষায় ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ কিংবা ইংরেজি পরীক্ষায় ‘Purpose of your life’ বিষয়ে রচনার সামনাসামনি হবার অভিজ্ঞতা আছে এবং বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে পাতার পর পাতা ভরিয়ে হয় মুখস্থ, নয় আপনমনের মাধুরী (মাধুরী দীক্ষিত নয়) মিশিয়ে আদর্শ জীবিকার কথা লিখে আসা সেসব অভিজ্ঞতাও আছে। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন পড়াশোনার চৌকাঠ পেরিয়ে কাজের জগতে মানে ওই যে জীবনের লক্ষ্যের ঘরে পা রাখার সময় এল বা আসে তখন? তখন টের পাওয়া যায় পরীক্ষায় লেখা রচনা আর বাস্তব মোটেই হরিহর আত্মা জাতীয় কিছু নয়। আর সেখান থেকেই শুরু হয় সত্যিকারের যুদ্ধ।
যদিও যুদ্ধ কথাটার মধ্যে বেশ একটা টানটান উত্তেজনাপ্রবণ ব্যাপার আছে। বেশ সাজোসাজো রব আছে। জয়ের পিপাসা আছে। আছে মক ড্রিলিং জাতীয় শিহরণ এবং সেই যুদ্ধ যতক্ষণ টিভির পর্দায় বা স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে ততক্ষণ বেশ রিলস বা মিম বানানো আছে। কিন্তু যুদ্ধটা যখন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যে কোনও পেশার জগতে ঢোকা এবং টিকে থাকা তখন বোঝা যায় ‘ life is just not a mattress of roses’ কাকে বল! এর আগেও অবশ্য যুদ্ধ থাকে। কারণ জীবন মানেই যুদ্ধ। তবে সেইসব যুদ্ধে পার্থসারথির মতো কারও না কারও ছাতা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু পেশার বিশেষত চাকরির রণক্ষেত্রে? পুরো কিশোরকুমারের গলায় – কেউ কারও কেউ নইকো আমি কেউ আমার নয় …
ধরে নেওয়া যাক লিখিত এবং মৌখিক মানে ইন্টারভিউয়ের সিঁড়ি ভেঙে আপনি একটা চাকরি পেয়ে গেলেন। তার মানেই জীবনভর শান্তির পতাকা উড়বে! সে গুড়ে বালি। যদি সরকারি চাকুরে হন, তাহলে অবধারিতভাবে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে কানাঘুষো চলবে- কোন চ্যানেলে কত দিয়ে ঢুকেছে কে জানে! কেউ বিশ্বাসই করবে না যে আপনি নিজের বুদ্ধির ঘামেই ওএমআর শিটের গোল্লা ভরিয়েছেন। এছাড়াও সরকারি চাকরিরে ভাই! আসে যায় মাইনে পায়, কাজ করলে উপরি পায় জাতীয় মিসাইল। আপনি যদি আধিকারিক হন তাহলে কারণে অকারণে ঘেরাও, কর্তৃপক্ষের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, ইউনিয়নের দাদাগিরি ইত্যাদি সহ্য করেও মাথা ঠান্ডা রাখার যুদ্ধটা চালাতে হবে। উত্তেজিত হয়েছেন কী জেনে রাখবেন অভিমন্যুর মতো আপনিও বেরোনোর কৌশল না জেনেই চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছেন। এর পরে আছে আরটিআই বোমা। কে কবে কোন ধামা যা এতদিন চাপা ছিল উলটে দেখে নিতে চাইবে চালে কতটা কাঁকর মেশানো আছে! অমনি কাঁকর-চালুনি হাপিস। অতএব চালের বস্তাই বাতিল।
আর আপনার চাকরির ক্ষেত্র যদি বেসরকারি হয় তাহলে তো কুরুক্ষেত্রও ফেল। সেখানে যুদ্ধের না আছে প্রস্তুতি পর্ব না আছে ১৮ দিনের সময়সীমা। সেখানে প্রতিদিনই স্নায়ুযুদ্ধ। হয়তো আপনার অজান্তেই কেউ বসের কান ভারী করে আপনাকে গাড্ডায় ফেলার ব্যবস্থা করবে! কিংবা পাশের ডেস্কে বসা কলিগ যাকে বন্ধু ভাবতেন, দেখা গেল তার দাক্ষিণ্যেই আপনার হাতে হ্যারিকেন মানে পিংক স্লিপ! আবার এটাও হতে পারে, যে আপনার অধস্তন ছিল, সে খানিক তৈল (অপ) ব্যবহার করে আপনারই উপরওয়ালা হয়ে বসল। আপনি থুড়িই না তখন বলতে পারবেন– ভালোমন্দ যাহাই ঘটুক সত্যেরে লও সহজে! আপনি তখন নিজেই পিটিএসডিতে (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) ভুগবেন। এছাড়াও আছে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ধাক্কা। রাত জেগে জার্নাল বা অনলাইন কোর্স করে নতুন টেকনলজিতে সড়োগড়ো হতে না হতেই দেখবেন তার ভার্সান চেঞ্জ কিংবা সেটা অ্যাবসোলুট হয়ে গেছে। আবার নিজেকে আপডেট করা। আপডেটেড হয়েও কিন্তু আপনার স্বস্তি নেই। কারণ এখন আবার এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) নামক পরমাণু বোমা সীমান্তে টহল দিচ্ছে। আপনার চাকরির টালমাটাল দশা এবং আপনি যে কর্মণ্যেবাধিকারস্তেমা ফলেষু কদাচন শ্লোক আউড়ে থেকে যাবেন সেটাও সম্ভব নয়। কারণ কর্মফলটাই আপনার ব্যালেন্স শিট। কারণ কর্মফলটাই আপনার এবং আপনার প্রিয়জনদের নিশ্চিন্তির রোটি কপড়া অউর মকান। আবার সেই ব্যালেন্স শিট ঠিক রাখতে গিয়ে দেখা গেল আপনার পারিবারিক ব্যালেন্স পুরো টাইটানিক হয়ে গেছে। যাকে বলে শাঁখের করাত। একদিকে ডেডলাইন টার্গেটে এসবের রক্তচক্ষু, অন্যদিকে অফিসেই থেকে গেলে পারো জাতীয় সুনামি। আর আপনি যদি এক্স এক্স মানে নারী চাকুরে হন তবে তো সোনায় সোহাগা। ঘরে এবং বাইরে মিলিয়ে আপনাকে হতেই হবে কমপক্ষে বিশ বা ত্রিশভুজা। তবুও দিনের শেষে গাজরটা সেই নাকের ডগাতেই ঝুলবে। তার উপর বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো ওরা তো ম্যাটারনিটি লিভ পায়, বসকে পটিয়ে প্রোমোশন জাতীয় শ্লেষও আপনার দিকে ছুটে আসবে।
নিজের কথাই বলি। কর্মসূত্রে (সরকারি) আউটডোর পোস্টিং হল। না কোনও ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে নয়, খোদ শিলিগুড়ি শহরে। কিন্তু হায়! সেখানে মহিলা শৌচালয় নাই। যদিও কাছেই সিনেমা হলে ‘টয়লেট এক প্রেমকথা’ দিব্যি হাউসফুল! আমার কাজটা আবার ঠিক দশটা-পাঁচটা জাতীয় নয় যে জল –পান ব্যাপারটা আগে পরে করে নেব। কতদিন এভাবে নির্জলা থাকা যায়! আমার কিছু সহকর্মী ফ্রিতে ট্রান্সফার নেবার সদুপদেশ দিলেন। কর্তৃপক্ষও অসুবিধার কথা ভেবে বদলির জন্য আবেদন করতে বললেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে কী পালিয়ে আসা যায়! কাজেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে টাগ অফ ওয়ার। শুরু হল টয়লেট এক রণকথা। সে অধ্যায়ে যদিও গুচ্ছের ম্যারাথন মিটিং শেষে সিদ্ধিলাভ (আলাদা শৌচালয়) হয়েছিল। কিন্তু মহিলা থাকা মানেই ঝামেলা, মহিলা মানেই বিভিন্ন অনাবশ্যক খরচ ধরনের টক্সিক কথাও শুনতে হয়েছিল।
তবে সরকারি বেসরকারি যাই হোক না কেন, পেশাগত জীবনে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা আসলে নিজের সঙ্গে নিজের। কেউ দেখতে না পেলেও সেখানে রক্ত ঝরে, পুঁজ জমে জমে দগদগে ঘা হয়ে যায়। কোনও খাঁখাঁ দুপুরে কিংবা নির্ঘুম রাতে ভিতরের আমিটা বলে কী হতে চেয়েছিলাম আর কী হলাম! আমাদের মধ্যেই অনেক অনেক অমলকান্তি আছে যারা রোদ্দুর হতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। অমলকান্তিরা রোদ্দুর হতে পারে না …।