- দেবদূত ঘোষঠাকুর
এতদিন শুনে এসেছি ‘মাঘের শীত বাঘের গায়ে’।
এটা একটা কথার কথা। বাস্তবে শীতের সঙ্গে বাঘের কোনও সম্পর্ক নেই। আর এবার মাঘ মাসের ঠান্ডার সঙ্গে বাঘের কোনও লড়াইয়ের ইতিহাসও চোখে পড়েনি। আমরা ‘বিপুল শক্তিধর’ বা ‘ক্ষমতাবান’ অর্থে ‘বাঘ’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। আসলে মাঘের শীতের তীব্রতা বোঝাতেই এই বাগধারাটি তৈরি হয়েছে। এক কালে মাঘ মাসে এমন শীত পড়ত যে, মানুষ তো ছাড়- পরম শক্তিশালী বাঘ পর্যন্ত কাবু হয়ে পড়ত।
আর এখন মাঘের শীতকে বাঘ কেন, মশারাও ডরায় না। শীতকে কাঁচকলা দেখিয়ে দিব্যি উড়ে বেড়ায় এদিক ওদিক, বাড়ির ভিতরেও। কিন্তু এই সময়টা তাদের নিরাপদ গরম আশ্রয়ে শীতঘুমে থাকার কথা। তারা কিনা বংশবিস্তার করে চলেছে ঘোর শীতের মাসেও! বর্ষায় মশা এখন শীতেরও মশা। মশার সহ্যশক্তি বাড়েনি, জিনগত কোনও পরিবর্তন হয়নি। আসলে পুরোপুরি বদলে গিয়েছে শীত।
আমরা যারা কলকাতায় থাকি, তাদের সঙ্গে শীত গত এক দশক ধরেই ‘আড়ি’ করে বসে আছে। পুলওভার, জ্যাকেট, মাঙ্কি ক্যাপ অপেক্ষা করে বসে থাকে দার্জিলিং, সিমলা বা কাশ্মীর ভ্রমণের জন্য। কর্মহীন হয়ে পড়ে থাকে ট্রাংক বা আলমারিতে, ন্যাপথালিনের সহবাসী হয়ে।
কলকাতার কথাই বা বলছি কেন, শিলিগুড়ি, ময়নাগুড়ি, মেখলিগঞ্জের মানুষও এবার সরব হয়েছেন শীত ‘চুরি’ যাওয়া নিয়ে। কে চুরি করল তাঁদের শীত? দিল্লি, শিমলা, নৈনিতালের মানুষের সঙ্গে চলুন একবার ঘুরে আসি শ্রীনগর থেকে। কাশ্মীর কেন? কারণ, ওটাই তো শীতের আঁতুড়।
সেই কাশ্মীরের কিন্তু মন ভালো নেই। রাজনৈতিক কারণে কাশ্মীর অস্থির হয়ে রয়েছে অনেক বছর ধরেই। এই একটি ভুখণ্ড নিয়ে বারবার যুদ্ধ হয়েছে। রাজনৈতিক খেলায় রাজ্যের মর্যাদাও হারিয়েছে। তবু প্রাকৃতিক সম্পদে কাশ্মীর এখনও ভূস্বর্গ। আর কাশ্মীরীদের মন খারাপের কারণ ওই প্রকৃতিই। স্বর্গে হানা দিয়েছে এক দৈত্য। বিশ্ব উষ্ণায়ন। মাঘের শীতটাই বেমালুম উবে গিয়েছে কাশ্মীর থেকে।
ঠিকমতো কালবৈশাখী না হলে, বর্ষা ঠিক সময়ে না হলে, গ্রীষ্ম দীর্ঘায়িত হলে আমরা সমতলের মানুষ যেমন আতঙ্কিত হই, কাশ্মীরে এবার অনেকটা সেই ধরনের একটি ঘটনাই ঘটেছে। এই শীতে পর্যাপ্ত তুষারপাতই হয়নি ভূস্বর্গে। আমি-আপনি ভাবতে বসব, তুষারপাত মানে তো সারাদিন ঘরে আটকে থাকা, জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়া। কনকনে ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে থাকা। এ সব বেশি না হওয়াই তো ভালো। যত কম হয় ততই মঙ্গল। কাশ্মীরের মানুষের দুঃখ পাওয়ার কী আছে?
আবহবিদরা বলছেন, শুধু কাশ্মীর নয়, তুষারপাতের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক আছে আমাদেরও। উত্তরবঙ্গ সহ আমাদের এই তল্লাটে, শীত কতটা হবে তার অন্যতম নিয়ন্ত্রক কাশ্মীর, কুলু মানালি, আলমোড়া পাহাড়ের তুষারপাত। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আছে কিন্তু কাশ্মীর।
আবহবিদরা বলছেন, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে ধেয়ে আসা একটি বায়ুপ্রবাহ, পশ্চিমী ঝঞ্ঝা ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢোকে কাশ্মীর দিয়ে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে দুটি বড়সড়ো পশ্চিমী ঝঞ্ঝা কাশ্মীরের ওপর দিয়ে যখন উত্তর ভারতের দিকে ধেয়ে আসে তার জেরে কাশ্মীরের পাহাড়ে পাঁচ থেকে সাতবার তুষারপাত হয়। তৈরি হয় কনকনে ঠান্ডা বাতাস।
দুটি পশ্চিমী ঝঞ্ঝাই দেশবাসীর শীতভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তার একটি সক্রিয় থাকে ডিসেম্বরে, অন্যটি জানুয়ারিতে। আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, লাদাখ এবং কাশ্মীর উপত্যকা যেখানে শীতের মরশুমে গড়ে ৫ থেকে ৭টি তুষারপাতের সম্মুখীন হয়, এবার সেখানে একটি দুর্বল ঝঞ্ঝা ছাড়া আর কিছুই হয়নি।
কিন্তু কী এই পশ্চিমী ঝঞ্ঝা? এই ঝঞ্ঝা হল ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা এবং ভারী বাতাস। সাধারণত কাশ্মীর দিয়ে তা ভারতে ঢোকে এবং তার পরে মধ্য ভারত দিয়ে পূর্ব ভারতে বয়ে যায়। কিংবা কখনো-কখনো উত্তরাখণ্ড হয়ে নেপালের দিকে চলে যায়। এই ধরনের ঝঞ্ঝার প্রভাবে কাশ্মীর, হিমাচলপ্রদেশে তুষারপাত হয়। বৃষ্টি হয় উত্তর-পশ্চিম ভারতে।
ঝঞ্ঝা সক্রিয় না থাকায় কাশ্মীরের বহু জায়গায় যেমন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি থেকেছে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, তেমনই সমতল এলাকাগুলিতে কুয়াশা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। সচরাচর ভূমধ্যসাগরের দিক থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস এই কুয়াশার চাদরকে সরিয়ে দিয়ে তুষারপাতের ফলে তৈরি কনকনে ঠান্ডা হাওয়াকে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার পর খুলে দেয়।
এবার তুষারপাত না হওয়ায় কনকনে হাওয়াটাই তৈরি হতে পারেনি। ফলে গোটা দেশেই মাঘে শীত ছিল অধরা। কাশ্মীরের এবার একটাই বড় ধরনের তুষারপাত হয়েছে। সেটা হয়েছিল ২৮ ডিসেম্বর। পশ্চিমী ঝঞ্ঝা না থাকায় জানুয়ারির তুষারপাত ফাঁকি দিয়েছে।
জোরালো উত্তুরে হাওয়া না থাকায় এবার কুয়াশার চাদর সহজে সরেনি কোথাও। বরং তা দীর্ঘায়িত হয়েছে, যা একদিকে যেমন ক্ষতি করেছে মানুষের শরীরের, তেমনই শীতকালীন ফসলের উৎপাদন মার খেয়েছে।
রাজ্যের উদ্যান বিভাগের রিপোর্ট বলছে, মালদায় বহু আম গাছে এখনও মুকুল আসেনি। অনেক মুকুলে আবার পোকা ধরে গিয়েছে। আলু চাষেরও ক্ষতি হয়েছে। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকায় ধসা রোগের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। অস্বাভাবিক আবহাওয়ায় ছড়াচ্ছে বার্ড ফ্লু’র জীবাণুও। মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য দপ্তরও।
কাশ্মীরের অর্থনীতির মূল দায়িত্ব পর্যটনের। বরফ না থাকায় এবার শীতে পর্যটক হারিয়েছে কাশ্মীর। এর থেকেও বড় বিপদের সম্মুখীন তারা। শীতকালীন বৃষ্টি আর তুষারপাতের অভাবে এবার গ্রীষ্মে পানীয় জলের হাহাকার তৈরি হতে পারে কাশ্মীর উপত্যকায়। কাশ্মীরের এক কৃষিবিজ্ঞানী জানাচ্ছেন, ২১ ডিসেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে কাশ্মীরে যে তুষারপাত হয়, তার ফলেই বাকি মরশুমে পানীয় জলের চাহিদা মেটে। এবার পানীয় জলের জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর ওপর অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। জলসংকটের ফলে কাশ্মীরের কৃষিও এই বছর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শুধু যে কাশ্মীর তা কিন্তু নয়। হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম এবং আমাদের দার্জিলিংও জলকষ্টে ভুগতে পারে। কারণ তুষারপাত হয়নি প্রায় কোথাও। আর আগামী বছরের মাঘেও যে তুষারপাত হবে, তার কোনও গ্যারান্টি দিতে পারছেন না আবহবিদরা।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে একটি বাগধারার এখনই অবলুপ্তি হওয়া দরকার। ‘এক মাঘে শীত যায় না’। এর ব্যাকরণগত অর্থ এক মাঘে শীত না পড়লেও পরের বছর মাঘে কনকনে শীত পড়তেও পারে। তবে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তার অর্থ ভিন্ন। একপ্রকার শ্লেষাত্মকভাবে বলা যে, ‘আজ তুমি আমাকে বিপদে ফেলে, সাহায্য না করে যাচ্ছ তো। বিপদ কিন্তু এই একবারই আসবে না।’
তবে মাঘ ও শীতের যুগলবন্দির যুগ বোধ হয় শেষ হতে চলেছে।
এবার বলার সময় আসছে- ‘মাঘে আর শীত হয় না’।
(লেখক সাংবাদিক)