সমস্ত ‘বাদ’ এর উপরে জাতীয়তাবাদ

সমস্ত ‘বাদ’ এর উপরে জাতীয়তাবাদ

আন্তর্জাতিক INTERNATIONAL
Spread the love


 

  • কৌশিকরঞ্জন খাঁ 

একটি ছোট্ট ছেলেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল – ‘ঘোড়া কার বাহন?’ সে নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছিল ‘নেতাজির’। আসমুদ্রহিমাচল কাঁপানো  রাজনীতির এই বাঙালি আইকন ঘরে ঘরে পূজিত। কত ছেলের নাম সুভাষ – এ তো ভোটার আইডি কার্ড বা আধার কার্ডের যাঁরা কাজ করেন, তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। বাঙালির ‘সোনার মানুষ’ নেতাজির চিন্তাজগৎ আশাবাদ ও আদর্শবাদে রঞ্জিত।

তিনি কারাবাসের দিনগুলোতে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রস্তুত করে গিয়েছেন। তিনি মনে করেছিলেন- “মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত আধ্যাত্মিক দিক থেকে অনেকটা লাভবান হতে পারব।” জেলকুঠুরিতে বসে যখন বাইরের জগৎ নিয়ে কিছু করতে পারছেন না, তিনি আত্মিক উন্নতির সাধনা করেছেন। এই গঠনমূলক মনোভাব একজন লড়াকু নেতার জন্ম দিয়েছে। তাই মাঝরাতে উঠে এলগিন রোডের বাড়ি ছেড়ে অনির্দেশের পথে পা বাড়ানোতেও তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট ছিল। চূড়ান্তভাবে মানসিক বলে বলীয়ান একজন বাঙালিই এই রোমাঞ্চকর পথ বেছে নিতে পারেন।

বাঙালির প্রতি তাঁর আস্থা প্রশ্নাতীত ছিল। “বাঙালির আত্মবিশ্বাস আছে, বাঙালির ভাবপ্রবণতা ও কল্পনাশক্তি আছে – তাই বাঙালি বর্তমান বাস্তব জীবনের সকল ত্রুটি, অক্ষমতা, অসাফল্যকে অগ্রাহ্য করে মহান আদর্শ কল্পনা করতে পারে।” তিনি সমস্ত ‘বাদ’ এর উপরে স্বাধীনতার সময় জাতীয়তাবাদকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কেননা জাতীয়তাবাদ ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। স্বাধীনতা না এলে অন্য কোনও ‘ইজম’ ই প্রতিষ্ঠা হওয়ার সুযোগ আসবে না।

তিনি বিশ্বাস করতেন – “কল্পনাশক্তি ও আত্মবিশ্বাস আছে বলেই বাঙলাদেশে এত সাধক জন্মেছে এবং এখনো জন্মাবে।” উন্নতিকামী জগতে কোনও মতকেই চরম সত্য হিসেবে ভাবার তিনি বিরোধী ছিলেন। কার্ল মার্কস সম্পর্কে নেতাজি বলেছেন, মার্কস চাইতেন তাঁর আদর্শ একইভাবে, রূপান্তরিত না হয়ে দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক। “আমি অন্য দেশের আদর্শ ও প্রতিষ্ঠান অন্ধভাবে অনুকরণ করার বিরোধী।”

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার নিবিড় যোগ ছিল। জেলে বসে লোকমান্য তিলক গীতার উপর আলোচনা লিখেছেন। অরবিন্দ কারাবাসের পর ঋষি হয়েছিলেন। চরমপন্থী বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি কালীপুজো করত। নেতাজি সেকুলার ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষের সমবেত যোগদানের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন হবে বলে মনে করতেন। কিন্তু তাঁর সেকুলারিজম নিজের ঈশ্বর ভাবনাকে বাদ দিয়ে নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন – ‘‘ভয় জয় করার উপায় শক্তি সাধনা। দুর্গা, কালী প্রভৃতি মূর্তি শক্তির রূপ বিশেষ।”

তাঁর জীবৎকালে তিনি অনুভব করেছিলেন ভারত আত্মার জাগরণ ঘটেছে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে – কাব্য সাহিত্যে, শিল্প বাণিজ্যে, ধর্ম কর্মে, কলা বিজ্ঞানে নতুন নতুন সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে ভারত পৃথিবীকে সাজিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আজ তিনি জীবিত থাকলে দেখতেন সেই যুগের মহত্ত্ব আজ তলানিতে। বাঙালির বৃহত্তম অংশ ফেরেববাজি রাজনীতি ও দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক।

আমরা দেখছি পতনোন্মুখ জাতির যে শ্রেণিচরিত্রে তিনি ভীত হতেন, ঘটছে তাই। জাতির সৃষ্টিশক্তি, চিন্তাশক্তি ও কর্মপ্রচেষ্টার গতানুগতিকতা, অ্যাডভেঞ্চার ও এন্টারপ্রাইজের স্পৃহা হ্রাস পেয়ে বাঁধা বুলি রোমন্থনে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে।

আরও একটা তেইশে জানুয়ারিতে এসে মনে হয় – সত্যিই, সুভাষ ঘরে ফেরে নাই। তিনি তো ফিরতে চেয়েছিলেন তরুণ সম্প্রদায়ের আদর্শ, আধ্যাত্মিকতা ও কর্মভাবনার মধ্যে দিয়ে। আমরা বাঙালিরা কি তাঁকে ঘরে ফেরাতে চাইছি?

(লেখক শিক্ষক। বালুরঘাটের বাসিন্দা)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *