সব্যসাচী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও সূর্য সেন

সব্যসাচী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও সূর্য সেন

শিক্ষা
Spread the love


 

  • সুস্মিতা সোম

‘ডাক্তার স্বীকার করিয়া কহিলেন, ঠিক তাই। কিন্তু একাই আরম্ভ করেছিলাম ভারতী! আর বিদেশ? কিন্তু ভগবান, এইটুকু দয়া করেছেন মানুষের মর্জিমতো ছোট-বড় প্রাচীরের বেড়া তুলে তাঁর পৃথিবীকে আর সহস্র কারাকক্ষে পৃথক করে রাখবার তিনি জো রাখেননি। উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে যতদূর দৃষ্টি যায় বিধাতার রাজপথ একেবারে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। একে রুদ্ধ করে রাখবার চক্রান্ত মানুষের হাতের নাগাল ডিঙ্গিয়ে গেছে। এখন এক প্রান্তের অগ্নুৎপাত অপর প্রান্তে স্ফুলিঙ্গ উড়িয়ে আনবেই আনবে ভারতী, সে তাণ্ডব দেশ-বিদেশের গণ্ডী মানবে না।

ডাক্তার ডাকিলেন, সরদারজী!

বাহির হইতে সাড়া আসিল, ইয়েস ডক্টর রেডি।’

পথের দাবী উপন্যাস এবং উপন্যাসের মূল বক্তব্য যে কয়টি ছোট মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়, সেইসব কারণকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর ব্রিটিশ শাসক বইটি বাজেয়াপ্ত করে। তাদের পক্ষ থেকে জোরালো যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছিল- ‘In direction of the tip of the e-book the hero works himself upon a state of frenzy, throws away all restraints and preaches pure Bolshevism.’ এই যুক্তির উত্তর শরৎচন্দ্র আগেই দিয়েছেন তাঁর উপন্যাসের পাতাতেই। বলেছেন- ‘জনকতক কুলি মজুরের ভাল করার জন্য পথের দাবী আমি সৃষ্টি করিনি। এর ঢের বড় লক্ষ্য। এমন করে এদের ভাল করা যায় না- এদের ভাল করা যায় শুধু বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে।’ অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন, জ্ঞানহীন দেশের মানুষ, পথের কুকুর যেমন পথে জন্মে পথেই মরে, কেউ খোঁজ নেয় না, দুঃখ পাওয়ার মনটাকেও যাঁরা নিংড়ে শেষ করে দিয়েছে সেইসব সর্বহারা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যেই এই উপন্যাস।

সব্যসাচীর মতো শরৎচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক বিপ্লবের আগে চাই সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সব্যসাচী তাই শশী কবিকে বলে- ‘প্রাণ খুলে শুধু সামাজিক বিপ্লবের গান শুরু করে দাও। যা কিছু সনাতন, যা কিছু প্রাচীন, জীর্ণ পুরাতন, ধর্ম, সমাজ, সংস্কার, সমস্ত ভেঙে চুরে ধ্বংস হয়ে যাক। এর চেয়ে ভারতের বড় শত্রু আর নেই।’ তার চাওয়ার মধ্যে ছিল স্বদেশি আন্দোলনের মহৎ কাজে যাঁরা অংশ নেবেন তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং মানবিকতায় পরিপূর্ণ একটি মন যেন থাকে। এই কারণেই তার আগের উপন্যাসগুলিতে তিনি রমেশ, বৃন্দাবন, বিপ্রদাসের মতো চরিত্রগুলি সৃষ্টি করেছিলেন। যেন এদের মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের মূল্যবোধগুলি রঙিন স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকে। এই শরৎচন্দ্র একসময় গান্ধিজিকে বলেছিলেন- ‘Achievement of freedom can solely be finished by troopers not by spiders’.

সাহিত্য রাজনীতির দায়ভার কাঁধে নিতে বাধ্য, একথা তিনি শুধু বলতেন না, বিশ্বাস করতেন, শুধু বিশ্বাস করেই দায়িত্বমুক্ত হননি, তিনি মাঠে নেমেই কাজের মধ্যে দিয়ে তা প্রমাণ করেছেন। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সর্বাধিনায়ক হেমচন্দ্র ঘোষ বলেছিলেন- ‘আমি যখনই জেলের বাইরে থাকতাম, তখনই তাঁর কাছে যেতাম। দাদা একবার বলেছিলেন, হেম, আমার রিভলভারটা তুমি নিয়ে যাও। আমি উত্তরে বলেছিলাম, রিভলভার নয়, আমাদের অভাব গুলির। আমার কথা শুনে তিনি তখনই তাঁর বাড়িতে যত গুলি ছিল সবই দিয়েছিলেন। এমনি আরও কয়েকবার গুলি এনেছি।’ অন্যদিকে হিজলী জেলের রাজবন্দিরা শরৎচন্দ্রকে গোপনে শহিদের রক্ত মাখা জাতীয় পতাকা পাঠিয়ে বলেছিলেন- ‘শরৎচন্দ্র বাংলার বিপ্লবযজ্ঞের অন্যতম ঋত্বিক, বাংলার নবযুগের একজন শ্রেষ্ঠতম বিপ্লবী এবং এই তার সত্য পরিচয়। -তিনি বিপ্লবের যুগ প্রবর্তক। তিনি সব্যসাচী নহেন সব্যসাচীর রথ সারথী।’

এইসব বিপ্লবীর জীবন থেকেই তিনি পথের দাবীর উপাদান সংগ্রহ করেছেন। বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ-এর স্মৃতিকথা থেকে আরও জানা যায়, শরৎচন্দ্র নিজে এক সভায় তরুণদের বলেছেন, ‘আমি কোনও বিশিষ্ট একজনকে আদর্শ করে সব্যসাচী লিখিনি। এইরকম একটা লোক আসুক, যে শেষ পর্যন্ত সমস্ত বাধা অতিক্রম করে লড়াই করে যেতে পারবে। এটাই আমি চেয়েছি। সেই আদর্শটাই তোমাদের কাছে তুলে ধরার জন্য আমি বইটা লিখেছি। সব্যসাচী তোমাদের জন্য।’ উপন্যাস শেষে তাই দল ভেঙে যাওয়া নায়ক সব্যসাচী দুর্যোগপূর্ণ গভীর রাতে সরদারজীকে সঙ্গে নিয়ে নৌকোয় পাড়ি দেয় নতুন উদ্যমে আবার বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য।

স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র আন্দোলন যখন বাংলাদেশের বুকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলে শেষ আঘাত হানার অপেক্ষায় দিন গুনছে, তখন পথের দাবী বইটি এই ধিকিধিকি আগুনকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় পরিণত করেছিল। সব্যসাচী একদিকে যেমন বলে- ‘শান্তি! শান্তি! শুনে শুনে কান একেবারে ঝালাপালা হয়ে গেছে। কিন্তু এ অসত্য এতদিন ধরে কারা প্রচার করছে জানো? পরের শান্তি হরণ করে যারা পরের রাস্তাজুড়ে অট্টালিকা প্রাসাদ বানিয়ে বসে আছে। তারাই এই মিথ্যা মন্ত্রের ঋষি।’ সব্যসাচী ভারতীকে আরও বলে- ‘বাঁধা গরুকে অনাহারে দাঁড়িয়ে মরতে দেখেছ ভারতী? সে দাঁড়িয়ে মরে, তবু জীর্ণ দড়িখানা ছিঁড়ে মালিকের শান্তি নষ্ট করে না।’

অন্যদিকে, এই সব্যসাচীই পুলিশের কাছে বিপ্লবীর নাম বলে দেওয়া অপূর্বকে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে ভারতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলে- ‘আমি বাঁচাতে গেলাম অপূর্বকে? আমি বাঁচালাম তোমার আর অপূর্বকে ভিত্তি করে ভালোবাসার যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে তাকে।’

শরৎচন্দ্র নিজে যদিও বলেছেন, সব্যসাচী কোনও একজনের চরিত্রকে অনুসরণ করেনি, তবে রাজনীতি ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের অবিচল বিশ্বাস ছিল চিত্তরঞ্জন দাশের ওপর। তিনি বলেছিলেন, ‘এই ভারতবর্ষের এত দেশ, এত জাতির মানুষ দিয়া পরিপূর্ণ বিরাট, বিপুল এই জনসঙ্ঘের মধ্যেও এতবড় মানুষ বোধ করি আর একটিও নাই। এই একান্ত নির্ভীক, এমন শান্ত, সমাহিত, দেশের কল্যাণে এমন করিয়া উৎসর্গ করা জীবন আর কই?’

বাংলাদেশে চিত্তরঞ্জনের বিরুদ্ধে নানারকম তীব্র সমালোচনায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘এই সাধারণ মানুষটি তাঁহার জীবদ্দশায় কতখানি দেশোদ্ধার করিয়া যাইবেন, তাহা ঠিক জানি না, কিন্তু যে অসাধারণ চরিত্রখানি তিনি দেশবাসীর অনাগত বংশধরগণের জন্য রাখিয়া যাইবেন, তাহা তার চেয়েও সহস্রগুণ বড়।’ ঠিক এমনি একটি অসাধারণ চরিত্রই পথের দাবীর সব্যসাচী।

গান্ধির নেতৃত্বে তখন ভারতজুড়ে শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। সেই সময় চৌরিচৌরায় পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে কয়েকজন পুলিশের মৃত্যু হয়। গান্ধি মিটিং করে আন্দোলন বন্ধ করে দিলেও পুলিশি অত্যাচারের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষও সেই অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ফলে সবাই তখন বিপ্লবীদের কাছে থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিল।

বিপ্লবীদের প্রতি এই সামাজিক বয়কট শরৎচন্দ্রকে ব্যথিত করেছিল। শরৎচন্দ্র বিপ্লবীদের সম্পর্কে এই সামাজিক বয়কটের গুরুত্ব উপলব্ধি করে হাওড়াতে সমস্ত মুক্ত রাজবন্দিকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন- ‘দেশের জন্য এরা জীবন উৎসর্গ করেছে, যৌবন উৎসর্গ করেছে, সর্বস্ব উৎসর্গ করেছে, এরাই দেশের মুক্তির অগ্রদূত। গভর্নমেন্ট এদের ভয় করে। কারণ জানে এদের তপস্যার মধ্যেই রচিত হচ্ছে তাঁদের ধ্বংসের মন্ত্র।’ শুধু তিনি বললেনই না, গ্রামে গ্রামে ঘুরে তরুণ প্রাণকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। এর ফলে বিপ্লবের মরাগাঙে যে ঢেউ উঠল সেখানে পরপর ঘটল ব্রিটিশের বুকে কাঁপন ধরানো একাধিক ঘটনা। যেমন, লালবাজারে টেগার্টকে হত্যা করার প্রচেষ্টা, বিনয়-বাদল-দীনেশের রাইটার্স অভিযান। ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের অভিযান, মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলি করা, ঢাকার আইবিকে গুলি করা- এইরকম একাধিক বিপ্লবী কর্মকাণ্ড।

চারুবিকাশ দত্ত ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি লিখেছেন, ‘শরৎচন্দ্রের পথের দাবী যখন আত্মপ্রকাশ করেছিল, তখন চট্টগ্রামের বিদ্রোহী নেতা সূর্য সেন ও আমি বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সের গ্রেপ্তার এড়াইয়া পলাতক জীবন যাপন করিতেছি… পথের দাবীর সব্যসাচীর চরিত্র ও জীবন আমাদের সেদিনের পলাতক জীবনের উপর গভীর রেখাপাত করে।… পাঠ সমাপ্ত করিয়া আমরা যখন ইহার গুণাগুণ লইয়া আলোচনায় ব্যাপৃত হইতাম, তখনও সূর্যবাবুর ধ্যান ভাঙিত না। সব্যসাচীর বিপ্লবী চরিত্রের এই অনুধ্যান করিতে সূর্য সেনকে সেদিন দেখিয়াছি।’

শরৎচন্দ্রের অকালমৃত্যুতে ব্যথিত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হরিপুরা কংগ্রেসের অধিবেশনে সেদিন বলেছিলেন- ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে ভারতবর্ষের সাহিত্য গগন থেকে উজ্জ্বলতর একটি নক্ষত্র অপসৃত হয়ে গেছে। বহু বৎসর ধরে তাঁর নাম বাংলার ঘরে ঘরে উচ্চারিত। শরৎচন্দ্র যদি সাহিত্যিক হিসাবে বিরাট হন, তিনি বোধহয় দেশপ্রেমিক হিসাবে বিরাটতর।’

(লেখক সাহিত্যিক মালদার বাসিন্দা)



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *